
রাজশাহী জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী একটি জেলা এবং রাজশাহী বিভাগের সদর শহর। এটি রাজশাহী বিভাগের সবচেয়ে বৃহত্তম ও প্রধান প্রশাসনিক অঞ্চল। প্রাচীন ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শিক্ষা-সংস্কৃতির সমন্বয়ে রাজশাহীকে বলা হয় “শিক্ষা নগরী” এবং “রেশম নগরী”।
আম ও লিচুর জন্য রাজশাহী বিশ্বজুড়ে পরিচিত, আর প্রচুর শাকসবজি উৎপাদনের কারণে এটি “সবজিভান্ডার” নামেও খ্যাত। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে রাজশাহী দেশের অন্যতম শীর্ষ জেলা।
নামকরণ
রাজশাহী নামের উৎপত্তি নিয়ে নানা মত আছে। ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র মতে, রাজশাহী নামটি রাণী ভবানীর দেওয়া।
একসময় রাণী ভবানীর জমিদারীকেই “রাজশাহী চাকলা” বলা হতো। পদ্মার উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকা, এমনকি ভারতের বর্ধমান ও বীরভূম পর্যন্ত এই অঞ্চল “রাজশাহী চাকলা” নামে পরিচিত ছিল।
ধারণা করা হয় “রামপুর” ও “বোয়ালিয়া” গ্রামের সমন্বয়ে রাজশাহী শহরের সূচনা হয়। প্রথমদিকে “রামপুর-বোয়ালিয়া” নামে পরিচিত থাকলেও পরে “রাজশাহী” নামটি স্থায়ী রূপ নেয়।
‘রাজশাহী’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘রাজ’ ও ফারসি ‘শাহী’ শব্দ থেকে, যার অর্থ রাজা বা রাজকীয়। নামটির অর্থ তাই “রাজা-রাজকীয়” বা “রাজাদের শহর”।
ইতিহাস
রাজশাহী বাংলাদেশের প্রাচীনতম প্রশাসনিক অঞ্চলের একটি। ১৯৮৪ সালে বৃহত্তর রাজশাহী ভেঙে চারটি পৃথক জেলা করা হয়—
১৮২৫ সালে বর্তমান রাজশাহী শহর প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। এর আগে সদর দপ্তর ছিল নাটোরে।
অবস্থান ও আয়তন
রাজশাহী জেলার—
- উত্তরে: নওগাঁ জেলা।
- দক্ষিণে: কুষ্টিয়া জেলা, পদ্মা নদী ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ।
- পূর্বে: নাটোর জেলা।
- পশ্চিমে: চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা।
মোট আয়তন প্রায় ২,৪০৭.০১ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশে প্রবেশকারী প্রধান নদী পদ্মা নদী এই জেলার সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে।
রাজশাহী জেলা যে কারণে বিখ্যাত
রাজশাহী তার রেশমবস্ত্র, আম, লিচু, এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর জন্য বিখ্যাত।
- রেশমবস্ত্র: রাজশাহীকে “রেশম নগরী” বলা হয়।
- ফল উৎপাদন: আম, লিচু, পেয়ারাসহ বহু ফল উৎপাদনে রাজশাহী শীর্ষে।
- শিক্ষা নগরী: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী কলেজসহ অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখানে অবস্থিত।
- সবজিভান্ডার: উদ্বৃত্ত শাকসবজির কারণে রাজশাহী কৃষি উৎপাদনে বিশেষ পরিচিত।
রাজশাহীর বিখ্যাত খাবার
রাজশাহীর খাবারের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী কালাই রুটি সবচেয়ে জনপ্রিয়।
- কালাই রুটি: মাষকলাইয়ের গুঁড়া ও আতপ চালের আটা দিয়ে তৈরি রুটি, যা সাধারণত হাঁসের মাংস বা ভর্তা দিয়ে খাওয়া হয়।
- কালাভুনা: কাটাখালীর কালাভুনা রাজশাহীর একটি বিখ্যাত খাবার।
- মুড়ি মাখা: মুক্তমঞ্চের মুড়ি মাখা স্থানীয়দের প্রিয় নাস্তা।
- পুরি মিষ্টি: সি অ্যান্ড বি মোড়ের পুরি মিষ্টি বিখ্যাত।
- হাঁসের মাংস: মরমারিয়ার হাঁসের মাংস বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
শিক্ষা ব্যবস্থা
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়
- রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল।
- গভ. ল্যাবরেটরি হাই স্কুল।
- রাজশাহী সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ।
- সিরোইল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়।
- পি এন সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
- হাজী মুহম্মদ মুহসীন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়।
বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়
- রাজশাহী লোকনাথ উচ্চ বিদ্যালয়।
- শাহ মুখদুম উচ্চ বিদ্যালয়।
- অগ্রণী বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়।
- মিশন স্কুল।
- নওদাপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
ইংলিশ মিডিয়াম
- চাইল্ড কেয়ার হোম।
- রয়্যাল একাডেমি।
- সামিট স্কুল।
সরকারি কলেজ
- রাজশাহী কলেজ।
- রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজ।
- রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ।
- নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ।
- শহীদ এ.এইচ.এম কামারুজ্জামান সরকারি কলেজ।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়
- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
- রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (RUET)।
- রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
- বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়।
- নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
- শাহ মখদুম ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটি।
মেডিকেল ও নার্সিং কলেজ
- রাজশাহী মেডিকেল কলেজ।
- ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ।
- বারিন্দ মেডিকেল কলেজ।
- শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজ।
- উদয়ন ডেন্টাল কলেজ।
- ইসলামী ব্যাংক নার্সিং কলেজ।
- ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন নার্সিং কলেজ।
কারিগরি প্রতিষ্ঠান
- রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।
- রাজশাহী মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।
- রাজশাহী কারিগরি ও জরিপ মহাবিদ্যালয়।
- রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কলেজ।
স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা
সরকারি হাসপাতাল
- রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক
- মাদারস ক্লিনিক।
- পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার (রাজশাহী শাখা)।
- মেডিল্যাব ডায়াগনস্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টার।
উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কেন্দ্র
- চান্দুড়িয়া ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র।
- কামারগাঁ উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র।
- কলমা, পাচন্দর, তালন্দ, সরনজাই কমিউনিটি ক্লিনিকসমূহ।
প্রশাসনিক ব্যবস্থা
উপজেলা
১. গোদাগাড়ী।
২. তানোর।
৩. মোহনপুর।
৪. বাগমারা।
৫. দুর্গাপুর।
৬. বাঘা।
৭. চারঘাট।
৮. পবা।
৯. পুঠিয়া।
পৌরসভা
রাজশাহী জেলায় মোট ১৪টি পৌরসভা, যেমন— বাঘা, আড়ানী, চারঘাট, পুঠিয়া, কাটাখালী, নওহাটা, কেশরহাট, ভবানীগঞ্জ, তাহেরপুর, মুন্ডুমালা, তানোর, দুর্গাপুর, গোদাগাড়ী, কাঁকনহাট।
সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম
রাজশাহীতে প্রকাশিত কিছু উল্লেখযোগ্য দৈনিক পত্রিকা—
- সোনালী সংবাদ।
- সোনার দেশ।
- আমাদের রাজশাহী।
- দৈনিক বার্তা।
- নতুন প্রভাত।
অনলাইন নিউজ পোর্টাল— সত্যের সকাল, সাহেববাজার২৪, পদ্মাটাইমস২৪, উত্তরবঙ্গ প্রতিদিন ইত্যাদি। এছাড়া রেডিও পদ্মা (৯৯.২ FM) ও রেডিও ফুর্তি (৮৮.০ FM) এখানকার জনপ্রিয় রেডিও স্টেশন।
রাজশাহীর দর্শনীয় স্থান
ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান
- পুঠিয়া রাজবাড়ি।
- বাঘা মসজিদ।
- বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর।
- গোবিন্দ মন্দির।
- পঞ্চরত্ন শিব মন্দির।
- রাজা কংস নারায়ণ মন্দির।
- তামলি রাজার বাড়ি।
- হাজারদুয়ারি জমিদার বাড়ি।
প্রাকৃতিক ও বিনোদনমূলক স্থান
- পদ্মা নদীর পাড়।
- শহীদ কামারুজ্জামান উদ্যান ও চিড়িয়াখানা।
- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
- পদ্মা গার্ডেন।
ধর্মীয় ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান
- শাহ মখদুম (র.) মাজার।
- শহীদ মিনার।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
রাজশাহীর যোগাযোগ ব্যবস্থা সড়ক, রেল ও বিমানপথে উন্নত।
- সড়কপথ: জেলার ভেতর ও বাইরে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে।
- রেলপথ: বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পর রেল যোগাযোগ আরও শক্তিশালী হয়েছে।
- বিমানপথ: রাজশাহী বিমানবন্দর থেকে ঢাকা ও অন্যান্য গন্তব্যে নিয়মিত ফ্লাইট চলে।
উপসংহার
রাজশাহী জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এক অনন্য অঞ্চল। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, কৃষি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অসাধারণ মেলবন্ধন এই জেলাকে করেছে বিশেষ। রাজশাহী শুধু “আমের রাজ্য” নয়, এটি বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির আলোকবর্তিকা।
FAQ
১. রাজশাহী জেলা কেন বিখ্যাত?
রেশমবস্ত্র, আম, লিচু ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য রাজশাহী বিখ্যাত।
২. রাজশাহীর ঐতিহাসিক স্থান কোনগুলো?
পুঠিয়া রাজবাড়ি, বাঘা মসজিদ, বরেন্দ্র জাদুঘর, পদ্মা নদীর পাড় ইত্যাদি।
৩. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় অবস্থিত?
রাজশাহী মহানগরের দক্ষিণ অংশে, মতিহার এলাকায়।
৪. রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী খাবার কী?
কালাই রুটি ও হাঁসের মাংস।
৫. রাজশাহীতে কয়টি উপজেলা আছে?
মোট ৯টি উপজেলা।



