
রংপুর জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর বিভাগের একটি প্রশাসনিক ও ঐতিহাসিক জেলা। এটি ভাওয়াইয়া গানের আকরভূমি হিসেবে পরিচিত এবং দেশের অন্যতম প্রাচীন জেলা।
১৭৬৫ সালে রংপুর জেলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর, ১৭৬৯ সালে এটি বিভাগীয় সদর দপ্তর হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ৭০০ বছরেরও বেশি ঐতিহ্যের ধারক এই জেলা বর্তমানে শতরঞ্জি (একটি জিআই পণ্য), হাড়িভাঙ্গা আম এবং তামাক উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে বিখ্যাত। রংপুরকে অনেকে ভালোবেসে ‘বাহের দেশ’ নামেও অভিহিত করে থাকেন।
রংপুর জেলার ইতিহাস
রংপুর জেলার ইতিহাস প্রাচীনকাল থেকেই সমৃদ্ধ। এই অঞ্চল প্রাচীন কামরূপ রাজ্যের অংশ ছিল।
পরবর্তীতে কামতেশ্বর নীলাম্বর সেন (১৪৮০–১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দ) এই অঞ্চলের অনেক অংশ শাসন করেন।
গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল
- ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে: রংপুর জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ১৬ ডিসেম্বর, ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে: রংপুর শহরকে বিভাগীয় সদর দপ্তর হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
নামের উৎপত্তি
রংপুর নামটি এসেছে “রঙ্গপুর” শব্দ থেকে, যার অর্থ “সুখের শহর”। আগে এই অঞ্চলকে ‘জঙ্গপুর’ বলা হতো। ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবের কারণে অনেকে একে ‘যমপুর’ বলত। পরবর্তীতে এর নাম পরিবর্তন হয়ে “রংপুর” হয়।
আন্দোলন ও প্রতিরোধ
ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে রংপুর বিভিন্ন আন্দোলন ও প্রতিরোধের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।
এই কারণে অনেক ঐতিহাসিকরা রংপুরকে বিদ্রোহের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
অবস্থান ও আয়তন
- অবস্থান: বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে।
- বিভাগ: রংপুর বিভাগ।
- মোট আয়তন: ২,৩৩৮.৩৯ বর্গ কিলোমিটার (৯০০.৮৯ বর্গ মাইল)।
- ভূগোল: রংপুর জেলা তিস্তা ও যমুনা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত উর্বর সমভূমি।
২০০৯ সালে রংপুর পৌরসভাকে রংপুর সিটি কর্পোরেশন এ উন্নীত করা হয়, যার আয়তন ৫০.৫৬ বর্গ কিলোমিটার।
নামকরণ
প্রাচীন কালে এই অঞ্চল কামরূপ ও পরে কোচরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রবাদ আছে, কামরূপরাজ ভগদত্তের প্রমোদস্থল হওয়ায় এর নাম রাখা হয় রঙ্গপুর। মুসলিম যুগে এই এলাকা পরিচিত ছিল ফৌজদারি ফকিরকুণ্ডি নামে।
রংপুর যে কারণে বিখ্যাত
- ভাওয়াইয়া গান: উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত।
- শতরঞ্জি: জিআই (Geographical Indication) পণ্য হিসেবে স্বীকৃত রংপুরের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প।
- হাড়িভাঙ্গা আম: বাংলাদেশের অন্যতম সুস্বাদু আমের জাত।
- বেগম রোকেয়া: নারী জাগরণের অগ্রদূত ও রংপুরের কৃতি সন্তান।
- তাজহাট রাজবাড়ী ও কারমাইকেল কলেজ: রংপুরের ঐতিহাসিক নিদর্শন।
- ভিন্ন জগৎ পার্ক ও রংপুর চিড়িয়াখানা: পর্যটন ও বিনোদনের কেন্দ্র।
রংপুর জেলার বিখ্যাত খাবার
- সিদোল দিয়ে বেগুন রান্না: ঐতিহ্যবাহী রংপুরী খাবার।
- হাড়িভাঙ্গা আম: মিষ্টি ও রসালো স্বাদের জন্য বিখ্যাত।
- শতরঞ্জি: যদিও এটি খাবার নয়, তবে রংপুরের ঐতিহ্যবাহী পণ্য হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাত।
- কাঁঠালের বিচি ভর্তা, রুই মাছ ভূনা, করলা ভাজি: জনপ্রিয় স্থানীয় পদ।
শিক্ষা ব্যবস্থা
রংপুর জেলা শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্যতম অগ্রগামী জেলা। এখানে সরকারি, বেসরকারি ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে সমৃদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
বিদ্যালয়
- রংপুর জিলা স্কুল।
- বীর উত্তম শহীদ সামাদ স্কুল এন্ড কলেজ।
- তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়।
- কেরামতিয়া উচ্চ বিদ্যালয়।
- রংপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
- বেগম রোকেয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।
কলেজ
- কারমাইকেল কলেজ।
- রংপুর সরকারি কলেজ।
- রংপুর ক্যাডেট কলেজ।
- বীর উত্তম শহীদ সামাদ কলেজ।
চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
- রংপুর মেডিকেল কলেজ।
- বেগম রোকেয়া সরকারি মহিলা মেডিকেল কলেজ।
- প্রাইম মেডিকেল কলেজ।
বিশ্ববিদ্যালয়
- বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
- তিস্তা ইউনিভার্সিটি (প্রাইভেট)।
নদ-নদীসমূহ
রংপুর জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বহু নদী রয়েছে, যা এই অঞ্চলের কৃষি ও সংস্কৃতির মূল উৎস।
প্রধান নদীসমূহ:
- তিস্তা নদী।
- ব্রহ্মপুত্র নদ।
- ঘাঘট নদী।
- করতোয়া নদী।
- চিকলী নদী।
- ধাইজান নদী।
- দুধকুমার নদী।
- মানাস নদী।
চিকিৎসা সুবিধা
রংপুর বিভাগীয় সদর হিসেবে স্বাস্থ্যসেবায়ও উন্নত অবস্থানে রয়েছে।
প্রধান সরকারি হাসপাতালসমূহ:
- রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।
- মা ও শিশু হাসপাতাল।
- বক্ষব্যাধি হাসপাতাল।
- রংপুর সদর হাসপাতাল (কলেরা হাসপাতাল নামেও পরিচিত)।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ:
- ক্রিস্টিয়ান মিশনারি হাসপাতাল।
- প্রাইম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
- রংপুর ডেন্টাল কলেজ।
দর্শনীয় স্থান
🏛️ ঐতিহাসিক স্থান
- তাজহাট জমিদার বাড়ি।
- কারমাইকেল কলেজ।
- ইটাকুমারী জমিদার বাড়ি।
- মন্থনা জমিদার বাড়ি।
- বেগম রোকেয়ার পৈতৃক বাড়ি (পায়রাবন্দ)।
- কেরামতিয়া মসজিদ ও শাহ কারামত আলী মাজার।
প্রাকৃতিক ও বিনোদন কেন্দ্র
- ভিন্ন জগৎ পার্ক।
- রংপুর চিড়িয়াখানা।
- চিকলি বিল ও পার্ক।
- ঘাঘট প্রয়াস পার্ক।
- মিঠাপুকুর শালবন।
মুক্তিযুদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী স্থান
- দমদমা বধ্যভূমি।
- ফকিরবাড়ি পল্লী জাদুঘর।
- দেবী চৌধুরাণীর পুকুর (পীরগাছা)।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
রংপুর জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত।
সড়ক, রেল ও আকাশপথে সহজ যাতায়াতের সুবিধা রয়েছে।
সড়কপথ
ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের সব বড় শহরের সঙ্গে সরাসরি বাস যোগাযোগ রয়েছে।
রেলপথ
রংপুর রেলওয়ে স্টেশনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে ট্রেন সংযোগ রয়েছে। ঢাকা থেকে সরাসরি রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেন চলে।
আকাশপথ
রংপুরে নিজস্ব বিমানবন্দর না থাকলেও নিকটবর্তী সৈয়দপুর বিমানবন্দর ব্যবহৃত হয়। বিমানবন্দরটি রংপুর শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
স্থানীয় পরিবহন
রিকশা, অটোরিকশা, সিএনজি, বাস ও ব্যক্তিগত যানবাহনের মাধ্যমে শহর ও উপজেলার মধ্যে যাতায়াত করা যায়।
উপসংহার
রংপুর জেলা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র। ঐতিহ্য, ইতিহাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মেলবন্ধনে রংপুর এক অনন্য জেলা। ভাওয়াইয়া গানের সুর, শতরঞ্জির রঙ, আর বেগম রোকেয়ার জাগরণে গড়া এই ভূমি আজও বাংলাদেশের গর্বের প্রতীক।
FAQ
১. রংপুর জেলা কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?
১৭৬৫ সালে রংপুর জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়।
২. রংপুর কেন বিখ্যাত?
শতরঞ্জি, হাড়িভাঙ্গা আম, ভাওয়াইয়া গান, ও বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান হিসেবে।
৩. রংপুরের প্রধান দর্শনীয় স্থান কোনগুলো?
তাজহাট জমিদার বাড়ি, কারমাইকেল কলেজ, পায়রাবন্দ, ভিন্ন জগৎ পার্ক ও রংপুর চিড়িয়াখানা।
৪. রংপুরে কোন বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে?
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং তিস্তা ইউনিভার্সিটি (প্রাইভেট)।
৫. রংপুরের বিখ্যাত খাবার কী?
সিদোল দিয়ে বেগুন রান্না ও হাড়িভাঙ্গা আম।



