
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের হৃদয়ে অবস্থিত বগুড়া জেলা, এক প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী নগরী, যার অতীত ইতিহাস হাজার বছরেরও পুরনো। এই জেলার নামকরণ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও দর্শনীয় স্থানগুলো যেন ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে আছে এক অপূর্ব মহিমায়।
নামকরণের ইতিহাস
বগুড়া নামের পেছনে রয়েছে এক চমৎকার ঐতিহাসিক কাহিনি।
১২শ শতকে বাংলার স্বাধীন সুলতান নাসিরুদ্দিন বগরা খান, যিনি ১২৭৯ থেকে ১২৮২ সাল পর্যন্ত বাংলার গভর্নর ছিলেন, তার নামানুসারেই এই অঞ্চলের নাম রাখা হয় ‘বগড়া’।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারণ ও লেখার পরিবর্তনে আজ তা পরিণত হয়েছে ‘বগুড়া’ নামেই, যা সমগ্র বাংলাদেশে পরিচিত এক ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
প্রাচীন কালে বগুড়া অঞ্চলটি পরিচিত ছিল পৌণ্ড্রবর্ধন নামে, যা ছিল বরেন্দ্রভূমির অংশ।
একসময় এটি ছিল সেন রাজাদের শাসনাধীন রাজধানী, আর তাই বগুড়া আজও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের এক অমূল্য ভান্ডার।
বগুড়া যে কারণে বিখ্যাত
বাংলাদেশের মিষ্টান্ন ইতিহাসে বগুড়ার দই এক অনন্য নাম।
২০০৭ সালে এটি “বাংলার সেরা দই” হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে এবং ২০২৩ সালে পায় ভৌগোলিক নির্দেশক (GI) সনদ — যা প্রমাণ করে এর স্বকীয়তা, ঐতিহ্য ও স্বাদে এর অনন্য মর্যাদা।
এই দই শুধু একটি খাবার নয়, এটি বগুড়ার গর্ব, সংস্কৃতির মিষ্টি প্রতীক।
দর্শনীয় স্থানসমূহ
বগুড়া ইতিহাসপ্রেমী ও ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এক স্বর্গরাজ্য। এখানকার প্রতিটি স্থাপনা যেন অতীতের স্মৃতি ধরে রেখেছে।
মহাস্থানগড় (প্রাচীন পুণ্ড্রনগর)
বাংলার প্রাচীনতম রাজধানী পুণ্ড্রনগর, যা আজ মহাস্থানগড় নামে পরিচিত। এখানে রয়েছে অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন —
- খোদার পাথর ভিটা।
- বৈরাগীর ভিটা।
- মানকালীর ঢিবি।
- শীলাদেবীর ঘাট.
- গোবিন্দ ভিটা।
- জাহাজ ঘাট।
- বেহুলা বাসরঘর, গোকুল মেধ।
- খেরুয়া মসজিদ।
- পরশুরামের প্রাসাদ।
- সওদাগর ভিটা।
- পদ্মার বাড়ি।
- বিষ মর্দন।
- যোগীর ভবন।
- জিয়তকুন্ড।
- মাজার শরীফ ও জাদুঘর।
যা প্রতিদিনই হাজারো পর্যটককে আকর্ষণ করে।
ভাসু বিহার
মহাস্থানগড়ের কাছেই অবস্থিত এই প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার, যা গৌতম বুদ্ধের যুগের স্থাপত্যকীর্তির সাক্ষী।
অন্যান্য ঐতিহাসিক নিদর্শন
বিহার ধাপ, পরশুরামের প্রাসাদ, মানকালীর কুণ্ড, যোগীর ভবণ ও ভীমের জাঙ্গাল — সবগুলোই মহাস্থানগড় এলাকার প্রাচীন গৌরবময় ইতিহাসের নিদর্শন।
বগুড়া জেলা ধর্মীয় ও বিনোদনমূলক স্থান।
- দুপচাঁচিয়ার কড়াতলী মন্দির — ঐতিহ্যবাহী হিন্দু ধর্মীয় স্থান।
- ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড বোটানিক্যাল গার্ডেন — প্রকৃতি ও বিশ্রামের মনোরম পরিবেশ।
- মম-ইন হোটেল ও ইকো পার্ক, ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্ক — আধুনিক বিনোদনের নতুন আকর্ষণ।
- পোড়াদহ মেলা — ইছামতি নদীর তীরে আয়োজিত লোকজ সংস্কৃতির এক রঙিন উৎসব।
- স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান
বগুড়া জেলায় রয়েছে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হাসপাতাল হলো
- শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল – উন্নত চিকিৎসার অন্যতম কেন্দ্র।
- বগুড়া সদর হাসপাতাল – সরকারি স্বাস্থ্যসেবার মূল ভিত্তি।
- নাযারী নাযাশী জেনারেল ও শিশু হসপিটাল।
- মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল।
সুপরিচিত বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র
- পপুলার হাসপাতাল।
- ইবনে সিনা হাসপাতাল।
- আনোয়ারা হাসপাতাল।
- পলাশ ক্লিনিক।
বগুড়া জেলার শিক্ষার প্রতিষ্ঠান
বগুড়া_শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। এখানকার কিছু খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো।
- সরকারি আজিজুল হক কলেজ।
- বগুড়া সরকারি কলেজ।
- সরকারি শাহ সুলতান কলেজ।
- কাহালু সরকারি কলেজ।
- নন্দীগ্রাম সরকারি মহিলা ডিগ্রি কলেজ।
- শেরপুর সরকারি কলেজ।
- গাবতলী সরকারি কলেজ।
- ধুনট সরকারি ডিগ্রি কলেজ।
- শহীদ এম. মনসুর আলী কলেজ।
- সান্তাহার সরকারি কলেজ।
- সরকারি শাহ্ এয়তেবারিয়া কলেজ ইত্যাদি।
শেষ কথা
বগুড়া শুধু একটি জেলা নয়, এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস আর স্বাদের এক অনন্য মেলবন্ধন।
মহাস্থানগড়ের ইতিহাস, দইয়ের মিষ্টতা, আর লোকজ মেলার রঙিন ছোঁয়া — সব মিলিয়ে বগুড়া এক জীবন্ত ইতিহাসের শহর।



