
ভূমিকা
জয়পুরহাট জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনিক অঞ্চল। কৃষিনির্ভর এই জেলা প্রাকৃতিক সম্পদ, ঐতিহাসিক নিদর্শন, ধর্মীয় স্থাপনা ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ।
অবস্থান ও আয়তন
- উত্তরে: দিনাজপুর জেলা
- দক্ষিণে: বগুড়া ও নওগাঁ জেলা
- পূর্বে: বগুড়া ও গাইবান্ধা জেলা
- পশ্চিমে: নওগাঁ জেলা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য
- মোট আয়তন: প্রায় ৯৬৫.৮৮ বর্গ কিলোমিটার
ইতিহাস
প্রাচীন যুগ
- জয়পুরহাট অঞ্চল প্রাচীনকালে গৌড়, পাল ও সেন রাজাদের অধীন ছিল।
- ধারণা করা হয়, রাজা ধর্মপাল ও রাজা জয়পাল এই অঞ্চলে শাসন করেছিলেন।
- এই এলাকার প্রাচীন নাম ছিল বাঘাবাড়ীহাট।
ব্রিটিশ শাসনকাল ও আধুনিক প্রশাসনিক বিকাশ
- ১৮২১ সালে বগুড়া জেলা গঠিত হলে জয়পুরহাট তার অংশ ছিল।
- ১৯১৪ সালে জয়পুরহাট মহকুমা গঠিত হয় এবং ১৯২৪ সালে এটি শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ১৯৭১ সালে মহকুমা হিসেবে পুনঃনিশ্চিত হয় এবং অবশেষে ১৯৮৪ সালে পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
নামের উৎপত্তি
জয়পুরহাট” নামটি নিয়ে ধারণা করা হয় যে, এটি রাজা জয়পাল-এর নাম থেকে উদ্ভূত। যদিও এর ঐতিহাসিক প্রমাণ সুস্পষ্ট নয়।
জয়পুরহাট জেলার অর্থনীতি
- অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর।
- অঞ্চলটি উত্তরাঞ্চলের “শস্যভান্ডার” হিসেবে পরিচিত।
- প্রধান শিল্প: চামড়া ও রাবার উৎপাদন।
- গুরুত্বপূর্ণ শিল্প প্রতিষ্ঠান: জয়পুরহাট চিনিকল ও জামালগঞ্জ কয়লাখনি।
প্রধান শস্য
ধান, আলু, ইক্ষু, লতিরাজ, কলা, মাল্টা।
রপ্তানিযোগ্য পণ্য
আলু, ধান, লতিরাজ, কাঁচা সবজি, সোনালী মুরগী ও চিনি।
খনিজ সম্পদ
চুনাপাথর
- অবস্থান: জামালগঞ্জ এলাকা
- গভীরতা: প্রায় ৫১৮ মিটার নিচে
- মজুদ পরিমাণ: আনুমানিক ১২০০ মিলিয়ন টন
কয়লা
- অবস্থান: জামালগঞ্জের পাহাড়পুর এলাকা
- গভীরতা: প্রায় ৬৪০ মিটার
- স্তর সংখ্যা: ৬টি
- মজুদ পরিমাণ: প্রায় ১০৫৩.৯০ মিলিয়ন টন
বিখ্যাত খাবার ও স্থানীয় পণ্য
- মাছের শিঙাড়া, রোল ও বল: আলুর পরিবর্তে মাছ দিয়ে তৈরি হওয়ায় এটি জয়পুরহাটের বিশেষ খাবার।
- শস্য ভান্ডার: উর্বর জমির কারণে এখানে প্রচুর ধান, সবজি ও আলু উৎপন্ন হয়।
বিখ্যাত স্থান ও ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানসমূহ
জয়পুরহাট সদর
- বেল আমলা বার শিবালয় (শিব মন্দির)
- পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমি
- ভীমের পান্টি, মঙ্গলবাড়ি
- দুয়ানী ঘাট
- হালট্টি চণ্ডী মন্দির (পুরানাপৈল)
- বিলের ঘাট (রাখালীয়া ব্রীজ)
- সিমেন্ট ফ্যাক্টরি
অন্যান্য উপজেলা
- আক্কেলপুর: গোপীনাথপুর মন্দির, বদ্ধভূমি, আক্কেলপুর রেলস্টেশন
- ক্ষেতলাল: হিন্দা-কসবা শাহী জামে মসজিদ, আছরাঙ্গা দীঘি
- কালাই: নান্দাইল দীঘি, পুনট
- পাঁচবিবি: নিমাই পীরের মাজার, লকমা জমিদার বাড়ি, পাথরঘাটা
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য স্থান
- বাংলাদেশ কয়লা, খনিজ ও ধাতব গবেষণা ইনস্টিটিউট, খঞ্জনপুর
- বাস্তবপুরী
- শিশু উদ্যান (প্রিন্স পার্ক)
- জয়পুরহাট চিনিকল লি.
- জামালগঞ্জ কয়লাখনি
নদী
১. ছোট যমুনা নদী
২. তুলসীগঙ্গা নদী
৩. হারাবতী নদী
৪. চিরি নদী
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী
জয়পুরহাট জেলায় বসবাসকারী প্রধান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো হলো:
- সাঁওতাল
- ওরাওঁ
- মুন্ডা
- মাহালী
- মালো
যোগাযোগ ব্যবস্থা
সড়কপথ
- পাকা রাস্তা: ৩৪২.৫৯ কিমি
- আধাপাকা রাস্তা: ৬১.৯৫ কিমি
- কাঁচা রাস্তা: ১,৫৯৬ কিমি
ঢাকা থেকে দূরত্ব: প্রায় ২৮০ কিমি
বাস সার্ভিস: হানিফ, শ্যামলী, শাহ ফতেহ আলী, সালমা, এস আর ট্রাভেলস
রেলপথ
- মোট রেলপথ: ৩৮.৮৬ কিমি
- স্টেশন সংখ্যা: ৭টি (জয়পুরহাট, পাঁচবিবি, জামালগঞ্জ, আক্কেলপুর, জাফরপুর, তিলকপুর ও বাগজানা)
- আন্তঃনগর ট্রেন: একতা, দ্রুতযান, নীলসাগর, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও চিলাহাটি এক্সপ্রেস।
শিক্ষা ব্যবস্থা
সরকারি কলেজ (৬টি)
১. জয়পুরহাট সরকারি মহিলা কলেজ
২. জয়পুরহাট সরকারি কলেজ
৩. সরকারি সাঈদ আলতাফুন্নেছা কলেজ
৪. আক্কেলপুর মুজিবর রহমান সরকারি কলেজ
৫. মহীপুর হাজী মহসীন সরকারি কলেজ
৬. কালাই সরকারি মহিলা কলেজ
বেসরকারি কলেজ (২১টি)
- কালাই ডিগ্রী কলেজ।
- জয়পুরহাট নাইট কলেজ।
- নুরনগর ইউনাইটেড ডিগ্রী কলেজ।
- মঙ্গলবাড়ি ময়েজ মেমোরিয়াল কলেজ।
- সরাইল আদর্শ কলেজ।
- পাঁচবিবি মহিলা কলেজ।
- জয়পুরহাট শহীদ জিয়া কলেজ।
- শালপাড়া আদর্শ কলেজ।
- আক্কেলপুর মহিলা কলেজ।
- জামালগঞ্জ কলেজ।
- শিরোট্টি কলেজ।
- রতনপুর কলেজ।
- হিচমি আদর্শ কলেজ।
- ভাদশা আইডিয়াল কলেজ।
- আমদাই ইউনাইটেড কলেজ।
- মাত্রাই মডেল কলেজ।
- পাঁচবিবি কলেজ।
- জয়পুরহাট মহিলা ডিগ্রী কলেজ।
- মোলামগারি আদর্শ কলেজ।
- তিলোকপুর মহাবিদ্যালয়।
- নান্দিয়াল দীঘি কলেজ।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা
সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক
- জেলা সদর হাসপাতাল, জয়পুরহাট
- জয়পুরহাট ডায়াবেটিস হাসপাতাল
- আধুনিক জেনারেল হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার
- পুলিশ হাসপাতাল, জয়পুরহাট
- রওশন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার
- তাজুল ইসলাম ডায়াগনস্টিক সেন্টার
- পদ্মা ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার
- গ্রীন লাইফ ডায়াগনস্টিক সেন্টার
- আল মদিনা ও আল শেফা ডায়াগনস্টিক সেন্টার
- সিভিল সার্জন অফিস, জয়পুরহাট
প্রশাসনিক বিভাগ
জয়পুরহাট জেলা মোট ৫টি উপজেলা নিয়ে গঠিত:
১. জয়পুরহাট সদর
২. আক্কেলপুর
৩. কালাই
৪. ক্ষেতলাল
৫. পাঁচবিবি
উপসংহার
জয়পুরহাট জেলা ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এক অঞ্চল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে এটি উত্তরবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় জেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
FAQ
১. জয়পুরহাট জেলা কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
জয়পুরহাট প্রথমে ১৯১৪ সালে মহকুমা হিসেবে গঠিত হয় এবং ১৯৮৪ সালে পূর্ণাঙ্গ জেলায় উন্নীত হয়।
২. জয়পুরহাট নামের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে?
ধারণা করা হয়, “জয়পুরহাট” নামটি রাজা জয়পালের নামানুসারে রাখা হয়েছে, যদিও এর সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।
৩. জয়পুরহাট জেলার প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তি কী?
জয়পুরহাটের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর; ধান, আলু, ইক্ষু ও চিনি এর প্রধান উৎপাদন।
৪. জয়পুরহাট জেলার বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান কোনগুলো?
ভীমের পান্টি, নান্দাইল দীঘি, হিন্দা-কসবা শাহী মসজিদ, আছরাঙ্গা দীঘি ও পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান।
৫. জয়পুরহাটে কোন খনিজ সম্পদ পাওয়া যায়?
জামালগঞ্জ এলাকায় চুনাপাথর ও কয়লার বিশাল মজুদ পাওয়া গেছে, যা বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ।



