
কুড়িগ্রাম জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চল। উপজেলার সংখ্যার দিক থেকে কুড়িগ্রাম একটি “এ” শ্রেণিভুক্ত জেলা। এই জেলার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে বহু নদ-নদী, যা একে করেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য। ইতিহাস, নদ-নদী, মুক্তিযুদ্ধ ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই জেলা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
ইতিহাস
১৮৫৮ সাল পর্যন্ত দেশটি পরিচালনা করত ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’। পরে ব্রিটিশ সরকারের হাতে শাসন ক্ষমতা চলে যায়। ব্রিটিশ আমলে কুড়িগ্রাম এলাকাটি চারটি থানায় বিভক্ত ছিল। ১৮৭৫ সালের ২২ এপ্রিল তারিখে একটি নতুন মহকুমা গঠিত হয় যার নাম হয় “কুড়িগ্রাম মহকুমা”।
ব্রহ্মপুত্র নদঘেষা এ অঞ্চলে বিভিন্ন প্রাচীন জনগোষ্ঠীর আগমন ঘটে এবং এখানে একটি সভ্যতার বিকাশ হয়। বারো থেকে দ্বাদশ শতকের প্রথম ভাগে সেন রাজবংশের শাসনকাল শুরু হয়। তাদের রাজধানী ছিল রাজারহাটের বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের চত্রা গ্রামে। সেনবংশের উল্লেখযোগ্য রাজারা হলেন — নীলধ্বজ সেন, চক্রধ্বজ সেন ও নীলাম্বর সেন। সেন রাজবংশের পতনের পর শুরু হয় মুঘল যুগ।
নামকরণ
“কুড়িগ্রাম” নামকরণের পেছনে নির্দিষ্ট কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ না থাকলেও একাধিক লোককথা প্রচলিত আছে—
- ধারণা করা হয়, মহারাজা বিশ্ব সিংহ কুড়িটি জেলে পরিবারকে এই অঞ্চলে প্রেরণ করেন। সেই কুড়িটি পরিবারের নাম থেকেই “কুড়িগ্রাম” নামের উৎপত্তি।
- বিলু কবীরের লেখা বাংলাদেশের জেলা নামকরণের ইতিহাস বই অনুযায়ী, এখানে কুড়িটি মেছো বা তৈলজীবী পরিবারের বসতি ছিল বলে নামকরণ হয়েছে “কুড়িগ্রাম”।
- আরও একটি মত অনুযায়ী, কুচবিহার রাজ্যের অন্তর্গত কোচ জাতির কুড়িটি পরিবার এখানে এসে বসবাস শুরু করে।
- অনেকে বলেন, “কুরি” নামক একটি নৃগোষ্ঠী এখানে বসবাস করত বলেই অঞ্চলটির নাম “কুড়িগ্রাম”।
এ অঞ্চল আজও তার প্রাচীন ঐতিহ্য ও ভাষাগত বৈচিত্র্য বহন করছে।
কুড়িগ্রামের বিখ্যাত খাবার
কুড়িগ্রাম জেলার বিখ্যাত খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছে সিদল ভর্তা এবং এখানকার প্রসিদ্ধ হাড়িভাঙ্গা আম। এছাড়াও, কুড়িগ্রামে তামাক ও আখ উৎপাদনও সমানভাবে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত।
সিদল ভর্তা
সিদল ভর্তা কুড়িগ্রামের ঐতিহ্যবাহী একটি জনপ্রিয় খাবার। এটি বিভিন্ন প্রজাতির শুঁটকি মাছ, নানা রকম মসলা ও উপকরণ একসঙ্গে বেটে তৈরি করা হয়। এর ঘ্রাণ ও ঝাল-টক স্বাদের কারণে এটি স্থানীয়দের কাছে অত্যন্ত পছন্দের একটি খাবার।
হাড়িভাঙ্গা আম
হাড়িভাঙ্গা আম কুড়িগ্রামের অন্যতম বিখ্যাত কৃষিপণ্য। এই আমের বিশেষত্ব হলো এর অতুলনীয় মিষ্টতা ও স্বাদ। প্রতি মৌসুমে দেশব্যাপী এর ব্যাপক চাহিদা থাকে, যা কুড়িগ্রামের কৃষকদের জন্য আয়ের বড় উৎস।
অন্যান্য
তামাক ও আখও কুড়িগ্রামের পরিচিত ফসল। জেলার বিভিন্ন এলাকায় এই দুটি ফসলের চাষ ব্যাপকভাবে হয়। এছাড়াও স্থানীয় হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোতে কুড়িগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন ঘরোয়া খাবার পরিবেশন করা হয়, যা পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
কুড়িগ্রাম জেলা নদনির্ভর একটি অঞ্চল। এখানে প্রবাহিত হয়েছে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমারসহ অসংখ্য নদ-নদী। এই নদীগুলোই জেলার ভূপ্রকৃতি, কৃষি ও জীবনযাত্রার প্রধান চালিকাশক্তি।
কুড়িগ্রাম জেলা যে কারণে বিখ্যাত
- ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ধরলা নদী—জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক।
- ১৯৭১ সালের চিলমারী রেইড—স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি ঐতিহাসিক অভিযান।
- ঐতিহ্যবাহী ক্ষীরমোহন মিষ্টি ও সিদল ভর্তার জন্যও কুড়িগ্রাম পরিচিত।
- বিখ্যাত ফল হাড়িভাঙ্গা আম এখানকার গর্ব।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
শংকর মাধবপুর গণহত্যা
১৯৭১ সালের ২ অক্টোবর পাকিস্তানি সেনারা রৌমারী থানার কোদালকাটি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুর, সাজাই ও ভেলামারী গ্রামে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। ৬৫ জন বেসামরিক মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়, যার মধ্যে ৫৭ জনই ছিলেন শংকর মাধবপুরের বাসিন্দা। এই গণহত্যা আজও কুড়িগ্রামের ইতিহাসে এক বেদনাবিধুর অধ্যায়।
রৌমারী ট্রেনিং ক্যাম্প
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রৌমারী উপজেলা ছিল মুক্তাঞ্চল। এখানেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো এবং পাকিস্তানি সেনারা কখনও এখানে প্রবেশ করার সাহস পায়নি। জিয়াউর রহমান তিন মাসেরও বেশি সময় রৌমারীতে অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন ও পরিচালনা করেন।
প্রশাসনিক এলাকা
কুড়িগ্রাম জেলায় মোট ৯টি উপজেলা, ৭৩টি ইউনিয়ন, এবং ১টি পৌরসভা রয়েছে।
উপজেলাসমূহ হলো:
- কুড়িগ্রাম সদর।
- ফুলবাড়ী।
- নাগেশ্বরী।
- ভুরুঙ্গামারী।
- উলিপুর।
- চিলমারী।
- রৌমারী।
- রাজিবপুর।
- রাজারহাট।
দর্শনীয় স্থানসমূহ
কুড়িগ্রাম জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- ধরলা সেতু ও ধরলা সেতু-২।
- সোনাহাট স্থলবন্দর (ভূরুঙ্গামারী)।
- চিলমারী বন্দর ও বড়াইবাড়ি যুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ।
- রৌমারী মুক্তিযুদ্ধ ট্রেনিং ক্যাম্প।
- উত্তরবঙ্গ জাদুঘর।
- কাচারী পুকুর পার্ক।
- কুড়িগ্রামের প্রথম শহীদ মিনার (মজিদা কলেজ)।
- বিজয়স্তম্ভ (স্টেডিয়াম সংলগ্ন)।
- রাজারহাটের ঠাটমারী ব্রিজ বধ্যভূমি।
- মেকুরটারী শাহী মসজিদ, চন্দামারী মসজিদ।
- কোটেশ্বর শিব মন্দির, পাঙ্গা ও ঘড়িয়ালডাঙ্গা জমিদার বাড়ি।
- নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়ি, ভেতরবন্দ জমিদার বাড়ি।
- সোনাহাট ব্রিজ, তুরা স্থলবন্দর ও রাজিবপুর সীমান্ত হাট।
- ফুল সাগর, টগরাইহাটের অচিন গাছ, দাশিয়ার ছড়া ইত্যাদি।
শিক্ষা
জেলার গড় শিক্ষার হার প্রায় ৪৪.৯৯%।
বিশ্ববিদ্যালয়
- কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
ইনস্টিটিউট
- কুড়িগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।
উল্লেখযোগ্য কলেজ
- কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ।
- কুড়িগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ।
- রৌমারী সরকারি কলেজ।
- উলিপুর সরকারি কলেজ।
- নাগেশ্বরী সরকারি কলেজ।
- চিলমারী সরকারি কলেজ।
- রাজারহাট সরকারি মীর ইসমাইল হোসেন কলেজ।
উল্লেখযোগ্য স্কুল
- কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়।
- কুড়িগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
- কুড়িগ্রাম কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজ।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান
- মসজিদ: ৩,৪৯৩টি।
- মন্দির: ১৮০টি।
- গির্জা: ৩টি।
অর্থনীতি
কুড়িগ্রামের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। প্রধান ফসলসমূহ হলো—ধান, গম, আলু, পাট, তামাক, সরিষা, আখ, ভুট্টা ও বাদাম। এখানে ৮৯৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে (৪টি বড়, ২৭টি মধ্যম ও ৮৬২টি কুটির শিল্প)। মোট আবাদযোগ্য জমি প্রায় ২,৫৯,৬০৮ একর।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর চালু হয় রাজধানী ঢাকা থেকে “কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস”, একটি সেমি-ননস্টপ ট্রেন। এছাড়া রংপুর এক্সপ্রেস এর শাটল ট্রেনও কুড়িগ্রাম যাত্রীদের সেবা দেয়।
হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্র
কুড়িগ্রাম জেলার প্রধান হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসমূহ—
- সদর হাসপাতাল, কুড়িগ্রাম।
- কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল।
- কুড়িগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল।
- মরিয়ম চক্ষু হাসপাতাল।
- এন.সি.ডি. কমিউনিটি হাসপাতাল।
- পপুলার জেনারেল হাসপাতাল।
- গ্রীন লাইফ জেনারেল হাসপাতাল।
- আধুনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল।
- নিউ ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
- আল শেফা, আল-আমিন, মা, লাইফ কেয়ার ও ডক্টরস ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
- রৌমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
- চিলমারী ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
- টিডিএইচ ফাউন্ডেশন, সূর্যের হাসি ক্লিনিক ইত্যাদি।
উপসংহার
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নদনির্ভর জীবন, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ঐতিহাসিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ কুড়িগ্রাম বাংলাদেশের এক অনন্য জেলা। এই জেলার নদী, সংস্কৃতি ও ইতিহাস আজও বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তকে করে তুলেছে গৌরবময়।
FAQ
১. কুড়িগ্রাম জেলা কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
১৮৭৫ সালের ২২ এপ্রিল কুড়িগ্রাম মহকুমা হিসেবে গঠিত হয়।
২. কুড়িগ্রাম জেলার বিখ্যাত খাবার কী?
ক্ষীরমোহন, সিদল ভর্তা, হাড়িভাঙ্গা আম, তামাক ও আখ।
৩. কুড়িগ্রাম জেলার নদ-নদী কয়টি?
এখানে প্রায় ১৬টি নদী ও ৪২০টিরও বেশি চরাঞ্চল রয়েছে।
৪. মুক্তিযুদ্ধের সময় কুড়িগ্রামের কোন স্থানটি মুক্তাঞ্চল ছিল?
রৌমারী উপজেলা।



