সিরাজগঞ্জ,সিরাজগঞ্জ জেলা,সিরাজগঞ্জ জেলা পর্যটন,সিরাজগঞ্জ দর্শনীয় স্থান,সিরাজগঞ্জ জেলা এর সংস্কৃতি,সিরাজগঞ্জ জেলা এর বিখ্যাত খাবার,সিরাজগঞ্জ জেলা এর ইতিহাস,সিরাজগঞ্জ জেলা ভ্রমণ, সিরাজগঞ্জ জেলা ইতিহাস,যমুনাসেতু,বঙ্গবন্ধু সেতু,

সিরাজগঞ্জ জেলা পরিচিতি ও ইতিহাস

সিরাজগঞ্জ জেলা বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চল এবং শিল্পসমৃদ্ধ শহর। এটি যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত এবং তাঁতশিল্পের জন্য বিশ্বজুড়ে খ্যাত। এখানকার তাঁতশিল্প ভৌগোলিক নির্দেশক (GI) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

সিরাজগঞ্জ পৌরসভার মোট আয়তন ২৮.৪৯ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ১,৮৮,৫২৮ জন (২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী)। ১৯১৫–১৯১৬ সালে রেল সংযোগের মাধ্যমে শহরটি “রেলের শহর” হিসেবে গড়ে ওঠে।

নামকরণ

সিরাজগঞ্জ নামটি এসেছে সিরাজ আলী চৌধুরী নামে এক জমিদারের নাম থেকে। ১৭৮৬–১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিসের আমলে তিনি বেলকুচি থানায় বসবাস করতেন। ১৭৮৭ সালে তিনি বড় বাজু পরগনার একটি অংশ পত্তনী হিসেবে লাভ করেন এবং সেখানে “সিরাজগঞ্জ জমিদারী” নামে একটি মহল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজ নামে একটি গঞ্জ বা বাজার স্থাপন করেন, যার নাম হয় সিরাজগঞ্জ

ইতিহাস

১৮০৯–১৮৩০ সালের মধ্যে যমুনা নদীকে কেন্দ্র করে সিরাজগঞ্জ বন্দর গড়ে ওঠে। যমুনার ভাঙনে তিনবার বন্দরটির স্থান পরিবর্তিত হয়। সর্বশেষ “ভূতেরদিয়ার” এলাকায় স্থানান্তরের পর সেখানেই গড়ে ওঠে বর্তমান সিরাজগঞ্জ শহর।১৮৪৫ সালের এপ্রিল মাসে সিরাজগঞ্জ ও জামালপুর মহকুমা স্থাপনের অনুমতি মেলে। প্রথমে এটি রাজশাহী ও ময়মনসিংহ জেলার অধীনে ছিল, পরে ১৮৪৬ সালের ২০ আগস্ট ফৌজদারি কার্যক্রম রাজশাহীর অধীনে স্থানান্তরিত হয়।

ভৌগোলিক অবস্থান ও আয়তন

সিরাজগঞ্জ জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত।

  • এটি রাজধানী ঢাকা থেকে উত্তর-পশ্চিমে,
  • রাজশাহী থেকে উত্তর-পূর্বে,
  • এবং বগুড়া থেকে দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত।
    অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ: ২৪º২২΄ থেকে ২৪º৩৭΄ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯º৩৬΄ থেকে ৮৯º৪৭΄ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ
    মোট আয়তন: ৩১.২৭ বর্গকিলোমিটার।

জনসংখ্যা ও শিক্ষার হার

  • জনসংখ্যা (২০২২): ১,৮৮,৫২৮ জন
  • জনঘনত্ব: প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৬৬০০ জন
  • শিক্ষার হার: ৮২.৭২% (৭ বছরের ঊর্ধ্বে জনগোষ্ঠী)।
  • মোট পরিবার বা খানা সংখ্যা: ৪৬,৯১১

সিরাজগঞ্জ যেটার জন্য বিখ্যাত

সিরাজগঞ্জ জেলা তার ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প এবং যমুনা সেতুর জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত।
এছাড়াও শহররক্ষা বাঁধ, নদীতীরবর্তী সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের জন্যও এটি সমাদৃত।

তাঁতশিল্প

সিরাজগঞ্জের তাঁতশিল্প শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বে পরিচিত। এখানে উৎপাদিত কাপড়ের মান, নকশা ও গুণগত মান অসাধারণ।

সিরাজগঞ্জ জেলার বিখ্যাত খাবার

পিথুলি

চালের গুঁড়ো দিয়ে রান্না করা গরুর মাংসের একটি ঐতিহ্যবাহী তরকারি। সিরাজগঞ্জ, কাজীপুর ও জামালপুর অঞ্চলে বিশেষ অনুষ্ঠানে এটি পরিবেশন করা হয়।

পানতোয়া

সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর অঞ্চলে জনপ্রিয় একটি বিখ্যাত মিষ্টি, যার স্বাদ তুলনাহীন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

সিরাজগঞ্জ শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ একটি জেলা। এখানকার বহু বিদ্বান, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ জাতীয়ভাবে পরিচিত।

বিশ্ববিদ্যালয় (২টি)

  • রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।
  • খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়।

মেডিকেল কলেজ (৩টি)

  • শহীদ এম. মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ।
  • নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ।
  • খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ।

কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

  • সিরাজগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।
  • শাহজাদপুর সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ।
  • সিরাজগঞ্জ সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ।

সরকারি কলেজ (১৩টি)

  • সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ।
  • ইসলামিয়া সরকারি কলেজ।
  • সরকারি রাশিদাজ্জোহা মহিলা কলেজ।
  • শাহজাদপুর সরকারি কলেজ।
  • সরকারি বঙ্গবন্ধু মহিলা ডিগ্রি কলেজ।
  • সরকারি বেগম নূরুণনাহার তর্কবাগীশ অনার্স কলেজ।
  • বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আইডিয়াল সরকারি কলেজ।
  • সরকারি আকবর আলী কলেজ।
  • সরকারি বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজ।
  • কাজীপুর সরকারি মনসুর আলী কলেজ।
  • বেলকুচি সরকারি কলেজ।
  • চৌহালী সরকারি কলেজ।
  • হাজী কোরাপ আলী সরকারি কলেজ।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান

  • সবুজ কানন স্কুল এন্ড কলেজ (১৯৮০)।
  • সিরাজগঞ্জ কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজ (২০০৩)।
  • সিরাজগঞ্জ পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজ (২০১১)।
  • সিরাজগঞ্জ আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ (২০১৯)।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহ

  • বিএল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৫৪)।
  • ভিক্টোরিয়া হাই স্কুল (১৮৯৮)।
  • সালেহা ইসহাক সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৩৭)।
  • হৈমবালা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৬৪)।
  • কওমী জুট মিলস হাই স্কুল (১৯৭৫)।
  • মল্লিকা ছানাউল্লাহ আনছারী উচ্চ বিদ্যালয় (২০০৪)।

দর্শনীয় স্থান

  • যমুনা সেতু।
  • শহীদ শামসুদ্দিন স্টেডিয়াম।
  • শহীদ শেখ রাসেল স্মৃতি পৌর শিশু পার্ক।
  • হার্ড পয়েন্ট।
  • চায়না বাঁধ।
  • রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি
  • চায়না বাঁধ
  • নবরত্ন মন্দির
  • ইলিয়ট সেতু

সিরাজগঞ্জ জেলার হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা

সরকারি:

  • সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল।
  • ট্রমা সেন্টার।
  • বক্ষব্যাধি ক্লিনিক।
  • সিভিল সার্জন অফিস।
  • খোকসাবাড়ি ১০ শয্যা হাসপাতাল।
  • সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।

বেসরকারি:

  • আরাফাত হাসপাতাল।
  • সেবা জেনারেল হাসপাতাল।
  • সেন্ট্রাল হাসপাতাল কমপ্লেক্স।
  • আল রাজি হাসপাতাল।
  • আল হেরা হাসপাতাল।
  • ন্যাশনাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
  • লাইফ কেয়ার হাসপাতাল।
  • শহীদ এম. মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

কামারখন্দ উপজেলা

সরকারি: কামারখন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
বেসরকারি: খোকন মেমোরিয়াল হাসপাতাল।

উল্লাপাড়া উপজেলা

সরকারি: উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র।
বেসরকারি:

  • উল্লাপাড়া জেনারেল হাসপাতাল।
  • ইবনে সিনা হাসপাতাল, আধুনিক হাসপাতাল।

রায়গঞ্জ উপজেলা

সরকারি: উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
বেসরকারি: আল-আমিন হাসপাতাল।

বেলকুচি উপজেলা

সরকারি: উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।

  • মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র।

বেসরকারি:

  • নিউ লাইফ হাসপাতাল।
  • ইসলামিয়া হাসপাতাল।

চৌহালী উপজেলা

সরকারি: উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
বেসরকারি:

  • খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।
  • খাজা ইউনুস আলী হার্ট ফাউন্ডেশন।

কাজিপুর উপজেলা

সরকারি:

  • উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
  • মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র।

বেসরকারি:

  • কাজিপুর জেনারেল হাসপাতাল।
  • নূর মেডিকেল সার্ভিস।

তাড়াশ উপজেলা

সরকারি: উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
বেসরকারি: তাড়াশ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল।

শাহজাদপুর উপজেলা

সরকারি:

  • উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
  • মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র।

বেসরকারি:

  • আল রাজি হাসপাতাল।
  • শহীদ নাসিম হাসপাতাল।
  • শাহজাদপুর ডায়াগনস্টিক হাসপাতাল।

পরিবহন ব্যবস্থা

সড়কপথ

সিরাজগঞ্জ শহরে কোনো জাতীয় মহাসড়ক না থাকলেও ২টি আঞ্চলিক ও ২টি জেলা সড়ক রয়েছে।

  • প্রধান সংযোগ সড়ক: আর৪৫০ (সয়দাবাদ–সিরাজগঞ্জ)আর৪৫১ (নলকা–সিরাজগঞ্জ)
  • ১৯৮৬ সালে প্রায় ৪ একর জমির উপর নির্মিত হয় সিরাজগঞ্জ কেন্দ্রীয় পৌর বাস টার্মিনাল।

রেলপথ

  • ১৯১৫–১৯১৬ সালে ঈশ্বরদী–সিরাজগঞ্জ লাইন চালুর মাধ্যমে রেল সংযোগ স্থাপিত হয়।
  • রেলওয়ে স্টেশনসমূহ: সিরাজগঞ্জ রায়পুর, সিরাজগঞ্জ বাজার, সিরাজগঞ্জ ঘাট ও বাহিরগোলা।
  • বর্তমানে সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন (ঢাকা–সিরাজগঞ্জ) চলাচল করছে (২০১৩ সালে চালু)।

উপসংহার

সিরাজগঞ্জ জেলা তার শিল্প, সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের জন্য বাংলাদেশের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। তাঁতশিল্প থেকে শুরু করে নদীতীরের সৌন্দর্য, পর্যটন স্থান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা — সব মিলিয়ে সিরাজগঞ্জ একটি সমৃদ্ধ জেলা, যা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

FAQ (Frequently Asked Questions)

১. সিরাজগঞ্জ জেলা কোথায় অবস্থিত?

 সিরাজগঞ্জ জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে রাজশাহী বিভাগে অবস্থিত। এটি যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত এবং ঢাকা থেকে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার দূরে।

২. সিরাজগঞ্জ নামের উৎস কী?

এই জেলার নামকরণ করা হয়েছে জমিদার সিরাজ আলী চৌধুরী-এর নামে, যিনি ১৮ শতকে এখানে “সিরাজগঞ্জ জমিদারী” ও একটি বাজার স্থাপন করেন।

৩. সিরাজগঞ্জ কী জন্য বিখ্যাত?

সিরাজগঞ্জ মূলত তার তাঁতশিল্প, যমুনা সেতু, এবং ঐতিহ্যবাহী পিথুলি ও পানতোয়া খাবারের জন্য বিখ্যাত।

৪. সিরাজগঞ্জ জেলায় কয়টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে?

সিরাজগঞ্জ জেলায় দুটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে —
১. রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।
২. খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়।

৫. সিরাজগঞ্জ জেলার প্রধান দর্শনীয় স্থানগুলো কী কী?

ইলিয়ট সেতু, শহীদ শামসুদ্দিন স্টেডিয়াম, চায়না বাঁধ, হার্ড পয়েন্ট ও শহীদ শেখ রাসেল স্মৃতি পৌর শিশু পার্ক হলো জেলার জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান।

৬. সিরাজগঞ্জ জেলার বিখ্যাত খাবার কী?

সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো পিথুলি (চালের গুঁড়ো ও গরুর মাংসের তরকারি) এবং জনপ্রিয় মিষ্টান্ন পানতোয়া

৭. সিরাজগঞ্জ জেলায় কয়টি মেডিকেল কলেজ রয়েছে?

এখানে তিনটি মেডিকেল কলেজ রয়েছে —
১. শহীদ এম. মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ।
২. নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ।
৩. খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ।

৮. সিরাজগঞ্জ জেলায় পরিবহন ব্যবস্থা কেমন?

সিরাজগঞ্জে সড়ক ও রেল—দুই ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে। সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের মাধ্যমে ঢাকা–সিরাজগঞ্জ রুটে প্রতিদিন যাতায়াত করা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *