নওগাঁর ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি, নওগাঁর প্যারা সন্দেশ, নওগাঁর বিখ্যাত খাবার, নওগাঁর বিখ্যাত প্যারাসন্দেশ, নওগাঁর বিশেষ মিষ্টি

নওগাঁর প্যারা সন্দেশ শতবর্ষের ঐতিহ্যে মিষ্টতার গল্প

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নওগাঁ জেলার গর্ব প্যারা সন্দেশ
দুধের ক্ষীর দিয়ে তৈরি এই ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন একসময় শুধু দেব-দেবীর পূজার নৈবেদ্য ছিল,
আর এখন এটি দেশের সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশের মিষ্টির প্রতীক হিসেবে পরিচিত।

ইতিহাসের মিষ্টি অধ্যায়

প্রায় শত বছরের পুরোনো এই প্যারা সন্দেশের ইতিহাস নওগাঁ শহরের কালীতলা এলাকা ঘিরে।
জনশ্রুতি আছে, এখানকার এক মিষ্টি কারিগর মহেন্দ্রী দাস-ই প্রথম এই সন্দেশ তৈরি শুরু করেন।
তিনি ভারতের বিহারের এক নবাবের দরবারে মিষ্টির কাজ করতেন।
নবাব নিহত হলে মহেন্দ্রী দাস প্রাণ বাঁচাতে নওগাঁতে চলে আসেন এবং জীবিকার প্রয়োজনে তৈরি করেন তাঁর নিজস্ব এক নতুন মিষ্টি — ‘প্যারা সন্দেশ’।

প্রথমে তিনি মন্দিরে মন্দিরে এই মিষ্টি বিক্রি করতেন।
পরে ‘মা নওগাঁর প্যারা সন্দেশ’ নামে একটি দোকান খোলেন, যা আজও নওগাঁর মিষ্টির ইতিহাসে এক কিংবদন্তি নাম।

মহেন্দ্রী দাসের পর তাঁর ছেলে ধীরেন্দ্রনাথ দাস, পরে সুরেশ চন্দ্র মহন্ত ও বর্তমানে বৈদ্য রতন দাস এই দোকানের উত্তরসূরি।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য— এখনো সেই পুরোনো রেসিপিতেই তৈরি হয় এই মিষ্টি,
এবং কারিগর নারায়ণ চন্দ্র দাস প্রজন্ম ধরে ধরে সেই ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রেখেছেন।

প্রস্তুত প্রণালী: মিষ্টির কারিগরি যাত্রা

প্যারা সন্দেশ তৈরি হয় মূলত দুধ, চিনি ও পানি দিয়ে —
তবে এর আসল কৌশল লুকিয়ে আছে দুধের ক্ষীর তৈরির প্রক্রিয়ায়।

🔹 প্রথম ধাপ

তরল দুধে সামান্য পানি মিশিয়ে বড় কড়াইয়ে জ্বাল দেওয়া হয়।
ঘন হয়ে আসা পর্যন্ত নাড়তে হয়, যতক্ষণ না তৈরি হয় ক্ষীর।

🔹 দ্বিতীয় ধাপ

ক্ষীরটি যখন কড়াইয়ের হাতায় লেগে আসতে শুরু করে, তখন গরম অবস্থায় তা হাতে নিয়ে রোল করে সামান্য চাপ দিলেই তৈরি হয় সোনালি-খয়েরি প্যারা সন্দেশ।

এক কেজি সন্দেশ বানাতে লাগে প্রায় ৭ লিটার দুধ, এবং এক কেজিতে পাওয়া যায় ৭৫–৮০টি প্যারা সন্দেশ।

বৈশিষ্ট্য ও সংরক্ষণ

প্যারা সন্দেশের রং হালকা খয়েরি, টেক্সচার নরম এবং মুখে দিলেই গলে যায় — এই বৈশিষ্ট্যই একে করেছে অনন্য। এটি সহজে ১০–১৫ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণযোগ্য, আর কৃত্রিম উপায়ে রাখলে আরও অনেক দিন টিকে যায়।

প্যারা সন্দেশের জনপ্রিয়তার রহস্য

  • অনন্য স্বাদ ও টেক্সচার: দুধের ক্ষীরের ঘন গন্ধে এটি মুখে দিলেই গলে যায়।
  • ঐতিহ্য ও ইতিহাস: শতবর্ষের ঐতিহ্য বহন করা এই মিষ্টির পেছনে আছে উত্তরবঙ্গের সংস্কৃতির গল্প।
  • ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান: এটি পূজা, বিবাহ ও অতিথি আপ্যায়নে অপরিহার্য।
  • উৎপত্তিস্থল: যদিও এখন সারাদেশে তৈরি হয়, কিন্তু আসল ও খাঁটি প্যারা সন্দেশের ঘর নওগাঁ
    আর এর কাছাকাছি জনপ্রিয়তা পেয়েছে পাবনার প্যারা সন্দেশ

স্বাদে, গন্ধে, ঐতিহ্যে

নওগাঁর প্যারা সন্দেশ এখন শুধুই একটি মিষ্টি নয় — এটি একটি ঐতিহ্যের প্রতীক, একটি ইতিহাসের স্বাদ, যা মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশের মিষ্টি মানেই নওগাঁর প্যারা সন্দেশ।”

উপসংহার

নওগাঁর প্যারা সন্দেশ শুধু একটি মিষ্টি নয়, এটি বাংলাদেশের মিষ্টান্ন ঐতিহ্যের এক জীবন্ত প্রতীক। শত বছরের ইতিহাস, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রক্ষা করা প্রস্তুত প্রণালী, আর দুধের ক্ষীরের অতুলনীয় স্বাদ—সব মিলিয়ে এই মিষ্টি আজও মানুষের মন জয় করে চলছে।

সময় বদলেছে, প্রজন্ম বদলেছে, কিন্তু নওগাঁর প্যারা সন্দেশের সেই খাঁটি স্বাদ ও ঐতিহ্য আজও অপরিবর্তিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *