
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে, রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী নওগাঁ জেলা। উপজেলার সংখ্যার দিক থেকে এটি একটি “এ” শ্রেণিভুক্ত জেলা, এবং ভৌগোলিকভাবে এটি বৃহত্তর বরেন্দ্র ভূমির অংশ।
বর্তমান নওগাঁ জেলা গঠিত হয় ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ, যখন পূর্বতন নওগাঁ মহকুমাকে পূর্ণাঙ্গ জেলায় উন্নীত করা হয়।
নওগাঁ শহর: ছোট যমুনার তীরে জেলার প্রাণকেন্দ্র
নওগাঁ শহর—ছোট যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত এক প্রাণচঞ্চল নগরী, যা নওগাঁ জেলার হৃদস্পন্দন হিসেবে পরিচিত। এই শহর শুধু একটি জনবহুল কেন্দ্র নয়, বরং প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক ও ঐতিহাসিক দিক থেকে পুরো জেলার প্রাণকেন্দ্র।
🔸 প্রশাসনিক গুরুত্ব:
নওগাঁ শহর হলো নওগাঁ জেলা ও সদর উপজেলার প্রশাসনিক সদরদপ্তর। এখান থেকেই জেলার সব সরকারি কার্যক্রম পরিচালিত হয়, যা একে প্রশাসনিক দিক থেকে অপরিহার্য করে তুলেছে।
🔸 বাণিজ্যিক কেন্দ্রবিন্দু:
এই শহরটি জেলার প্রধান ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র। বাজার, শপিং কমপ্লেক্স ও বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান শহরটিকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করেছে, ফলে এটি নওগাঁর বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত।
🔸 ভৌগলিক অবস্থান:
ছোট যমুনা নদীর তীরে অবস্থান শহরটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উভয়কেই বাড়িয়ে দিয়েছে। এই অবস্থান নওগাঁ শহরকে জেলার অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সহজে যুক্ত করেছে।
🔸 ঐতিহাসিক পরিচিতি:
১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত নওগাঁ জেলা পরিষদ পার্ক শহরের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের জীবন্ত প্রতীক। এটি শুধু একটি বিনোদনকেন্দ্র নয়, বরং নওগাঁ শহরের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের স্মারক।
সব মিলিয়ে বলা যায়—নওগাঁ শহর তার প্রশাসনিক শক্তি, বাণিজ্যিক বিকাশ, ভৌগলিক অবস্থান ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের মাধ্যমে পুরো জেলার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
নামের উৎপত্তি ও অর্থ
নওগাঁ নামটির উৎপত্তি হয়েছে ‘নও’ (ফরাসি শব্দ, অর্থাৎ “নতুন”) এবং ‘গাঁ’ (বাংলা শব্দ, অর্থাৎ “গ্রাম”)—এই দুই শব্দের সমন্বয়ে। অর্থাৎ, “নওগাঁ” মানেই নতুন গ্রাম।
প্রথমে নওগাঁ শহরের নাম থেকেই গঠিত হয় নওগাঁ থানা, পরে মহকুমা, আর বর্তমানে এই নামেই পরিচিত পুরো জেলা।
এই নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক নবজাগরণের প্রতীক—“নতুন গ্রামের নতুন সূচনা।”
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে নওগাঁর ভূমিকা
নওগাঁ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের নাম।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর, নওগাঁয় গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ।
এর কেন্দ্র ছিল নওগাঁ কে.ডি. সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে, যেখানে স্বাধীনতার কর্মসূচিগুলো পরিচালিত হতো।
সে সময় নওগাঁ ছিল ইপিআর (East Pakistan Rifles) ৭নং উইং-এর হেডকোয়ার্টার।
১৮ মার্চ পর্যন্ত এর কমান্ডে ছিলেন পাঞ্জাবি মেজর আকরাম বেগ। কিন্তু মুক্তিকামী বাঙালি অফিসার মেজর নজমুল হক, তরুণ নেতা আব্দুল জলিলসহ স্থানীয় মুক্তিকামীদের সহযোগিতায় ২৪ মার্চ পাক অফিসারদের গ্রেফতার করে নওগাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মুক্ত এলাকাগুলোর একটিতে পরিণত করেন।
এই সময়েই নওগাঁয় মঞ্চস্থ হয় এক ঐতিহাসিক নাটক—“রক্ত শপথ”, রচনা করেছিলেন অধ্যাপক খন্দকার মকবুল হোসেন।
এই নাটক স্বাধীনতার বার্তা ছড়িয়ে দেয় ভারত ও বাংলাদেশের নানা প্রান্তে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেয় মানুষের হৃদয়ে।
ঐতিহাসিক ও পর্যটন স্থান
নওগাঁর প্রতিটি ইট-পাথর যেন বলে যায় ইতিহাসের গল্প।
এ জেলার গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও পর্যটন স্থানগুলো হলো—
- পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার — UNESCO ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য, প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার অনন্য নিদর্শন।
- কুসুম্বা মসজিদ — ১৬শ শতকের শৈল্পিক স্থাপত্যের এক অনন্য উদাহরণ।
- বলিহার রাজবাড়ী — রাজকীয় ঐতিহ্য ও স্থাপত্যকৌশলের অপূর্ব নিদর্শন।
- রঘুনাথ মন্দির, ঠাকুরমান্দা ও জগদ্দল বিহার — ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতীক।
- আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যান ও রক্তদহ বিল — প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর স্থান।
- দুবলহাটি রাজবাড়ি।
- হাঁসাইগাড়ী বিল।
- নওগাঁর মাটির প্রাসাদ।
- ভবানীপুর জমিদার বাড়ি।
- মহাদেবপুর জমিদার বাড়ি।
- জগদ্দল বিহার।
- জবই বিল।
- ঘুঘুডাঙ্গা তালতলি।
- ইসলামগাঁথী মসজিদ।
- আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান।
ঐতিহ্যবাহী খাবার
নওগাঁর কথা উঠলে মুখে আসে এক মিষ্টি নাম — প্যারা সন্দেশ!
দুধ ও চিনি দিয়ে তৈরি এই ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন নওগাঁর নিজস্ব স্বাদ বহন করে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসে শুধুমাত্র এই প্যারা সন্দেশের স্বাদ নিতে।
শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠান
নওগাঁ শুধু ঐতিহ্যে নয়, শিক্ষায়ও সমৃদ্ধ একটি জেলা।
এখানে সরকারি, বেসরকারি ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক বিস্তৃত নেটওয়ার্ক রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য কলেজসমূহ:
- নওগাঁ সরকারি কলেজ।
- সরকারি বিএমসি মহিলা কলেজ।
- ফয়েজ উদ্দীন মেমোরিয়াল কলেজ।
- নওগাঁ আস্তানমোল্লা ডিগ্রি কলেজ।
- বলিহার ডিগ্রি কলেজ।
- তেঁতুলিয়া বিএমসি কলেজ।
- ভীমপুর আদর্শ কলেজ।
কারিগরি প্রতিষ্ঠানসমূহ:
- নওগাঁ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।
- নওগাঁ টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ।
- টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট।
এইসব প্রতিষ্ঠান নওগাঁকে গড়ে তুলছে দক্ষ মানবসম্পদের এক শিক্ষানগরীতে।
স্বাস্থ্যসেবা
নওগাঁ জেলা স্বাস্থ্যসেবায়ও পিছিয়ে নেই।
এখানে রয়েছে একটি ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতাল এবং নওগাঁ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
এছাড়াও অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক এই জেলার মানুষের চিকিৎসায় নিরলসভাবে কাজ করছে।
সরকারি হাসপাতাল:
- নওগাঁ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতাল।
- নওগাঁ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক:
- বেডো জেনারেল হাসপাতাল।
- গ্রামীণ হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক।
- ইস্পাহানি চক্ষু ইনস্টিটিউট।
- বেস্ট কেয়ার ইসলামী হাসপাতাল।
- গ্রীণ লাইফ হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক।
উপসংহার
নওগাঁ শুধু একটি জেলা নয়—এটি বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ ও সংস্কৃতির এক মহাকাব্যিক প্রতিচ্ছবি।
এখানকার মানুষের সরলতা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শন আর প্যারা সন্দেশের মিষ্টতা—সব মিলিয়ে নওগাঁ হলো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের এক জীবন্ত ইতিহাসের শহর।



