জমিদার কৃষ্ণনাথ রায়,দুবলহাটি জমিদার বাড়ি,জমিদার বাড়ি,নওগাঁ জমিদার বাড়ি,নওগাঁ দুবলহাটি জমিদার বাড়ি

জমিদার কৃষ্ণনাথ রায় : সংক্ষিপ্ত জীবনী

জন্ম ও শিক্ষা

১৮২২ সালের ১২ মার্চ মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজার রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জমিদার কৃষ্ণনাথ রায়। তাঁর পিতা ছিলেন জমিদার হরিনাথ রায় এবং মাতা হরসুন্দরী দেবী। মাত্র দশ বছর বয়সে পিতার মৃত্যু হলে, ব্রিটিশ সরকারের নিয়ম অনুসারে তিনি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হন (১৮৩২–১৮৪০)।

শিক্ষায় কৃষ্ণনাথ ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। অল্প বয়সেই তিনি ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। তাঁকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদান করতেন বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা—

  • ইংরেজি, ইতিহাস, জ্যামিতি, ভূগোল, রসায়ন ও জ্যোতির্বিদ্যা শেখাতেন ব্রিটিশ অভিভাবক উইলিয়াম স্টিফেন ল্যামব্রিক।
  • সংস্কৃত ও বাংলা শেখাতেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক শিক্ষাবিদ পণ্ডিত শিবপ্রসাদ।

এছাড়া ডিরোজিওর ছাত্র দিগম্বর মিত্রের সংস্পর্শে এসে তিনি মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীল মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ কৃষ্ণনাথ দিগম্বর মিত্রকে এক লক্ষ টাকা দান করেছিলেন।

১৮৩৬ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি স্বর্ণময়ী দেবীকে (বিবাহোত্তর নাম সারদাসুন্দরী) বিবাহ করেন। তবে তাঁদের দুই কন্যা—লক্ষ্মী ও সরস্বতী অল্প বয়সেই মারা যান।

জনহিতকর কার্যক্রম

কৃষ্ণনাথ রায় শৈশবকাল থেকেই শিক্ষা ও সমাজসেবায় অনন্য অবদান রাখেন।

  • ১৮৩৫ সালে, মাত্র ১৩ বছর বয়সে, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রথম পাঁচজন ছাত্রকে ১,০০০ টাকা করে পুরস্কার দেন।
  • ১৮৩৭ সালে, মাত্র ১৫ বছর বয়সে সৈদাবাদে একটি ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
  • ১৮৩৮ সালে, তাঁর উদ্যোগে প্রকাশিত হয় মফস্বল বাংলার প্রথম ইংরেজি পত্রিকা মুর্শিদাবাদ নিউজ। যদিও সরকারের রোষানলে পড়ে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।
  • পরের বছর (১৮৪০ সালে) তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষার সাপ্তাহিক পত্রিকা মুর্শিদাবাদ সম্বাদপত্রী। কিন্তু নির্ভীক সাংবাদিকতার কারণে এটিও সরকারি চাপে বন্ধ হয়ে যায়।

১৮৪১ সালে তিনি সাবালক হয়ে ওঠেন এবং ১৮৪২ সালে লর্ড অকল্যান্ড তাঁকে “রাজা” উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল মুর্শিদাবাদে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। সেই লক্ষ্যেই মাত্র উনিশ বছর বয়সে তিনি একটি উইল করে যান।

জমিদার কৃষ্ণনাথ রায় এর জীবনাবসান

যদিও কৃষ্ণনাথ ছিলেন আধুনিক, প্রগতিশীল ও উদারচেতা, তবুও জীবনের শেষদিকে তিনি নানা সংকটে পড়েন।

  • বিলাসিতার কারণে ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে।
  • পারিবারিক অশান্তি ও মাতার সঙ্গে দ্বন্দ্বও তাঁকে কষ্ট দেয়।
  • শেষমেশ এক মিথ্যা অপবাদে আত্মসম্মান রক্ষার জন্য তিনি চরম সিদ্ধান্ত নেন।

১৮৪৪ সালের ৩০ অক্টোবর, মাত্র ২২ বছর বয়সে, তিনি কলকাতার জোড়াসাঁকো রাজবাড়ীতে আত্মহত্যা করেন।

মৃত্যুর আগে লেখা উইলে তিনি তাঁর বেশিরভাগ সম্পত্তি সমাজকল্যাণে দান করে যান। তবে পরে আদালতের রায়ে তাঁর স্ত্রী মহারাণী স্বর্ণময়ী সেই উইল খারিজ করে দেন।

উপসংহার

জমিদার কৃষ্ণনাথ রায়ের জীবন ছিল এক বিস্ময়কর বৈপরীত্যের কাহিনী। একদিকে তিনি ছিলেন প্রগতিশীল, দানশীল ও সমাজকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ; অন্যদিকে ব্যক্তিগত জীবনের ব্যর্থতা ও অপবাদ তাঁকে অকালমৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তবুও তিনি বাংলা সমাজে শিক্ষা ও সাংবাদিকতার ইতিহাসে অগ্রদূত হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *