শেরপুর জেলা

শেরপুর জেলা পরিচিতি ও ইতিহাস

শেরপুর জেলা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। একসময় এটি ঢাকা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল (১৮২৯–২০১৫ সাল পর্যন্ত)। জেলার মোট আয়তন ১,৩৬৩.৭৬ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ২৬ লক্ষাধিক। শেরপুর পূর্বে জামালপুর মহকুমার একটি থানা ছিল, পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পূর্ণাঙ্গ জেলায় উন্নীত হয়। জেলা সদর ঢাকার প্রায় ১৮৩ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।

ইতিহাস

প্রাচীনকালে শেরপুর অঞ্চল কামরূপা রাজ্যের অংশ ছিল। মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে এ অঞ্চল “দশকাহনিয়া বাজু” নামে পরিচিত ছিল। সেই সময় ব্রহ্মপুত্র নদ পারাপারের জন্য দশ কাহন (১২৮ পিস মুদ্রা) খরচ হতো বলে এই নামের উৎপত্তি। সপ্তদশ শতকে ভাওয়ালের গাজী বংশ এই এলাকা দখল করে এবং গাজী বংশের শেষ জমিদার শের আলী গাজী-এর নামানুসারে অঞ্চলটির নাম রাখা হয় শেরপুর।

ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সময় টিপু শাহ এই এলাকায় স্বাধীনতা ঘোষণা করে গরজরিপাকে রাজধানী ঘোষণা করেছিলেন। ১৮৯৭ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্প ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে যমুনার সঙ্গে যুক্ত করে এবং শেরপুর অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।

নামকরণ

“শেরপুর” নামটি এসেছে শাসক শের আলী গাজী-এর নাম থেকে। এর পূর্ব নাম ছিল “দশ কাহোনিয়া”, যেখানে “কাহন” ছিল ১২৮ পিসের একটি গণনা একক।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেরপুরকে বাংলাদেশের ৬১তম জেলা হিসেবে ঘোষণা করেন।

অবস্থান ও আয়তন

  • অবস্থান: বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে, ময়মনসিংহ বিভাগের অংশ।
  • আয়তন: ১,৩৬৩.৭৬ বর্গকিলোমিটার (৫২৬.৫৫ বর্গমাইল)।

নদ-নদী

শেরপুর জেলা নদীসমৃদ্ধ অঞ্চল। জেলার প্রধান নদীগুলো নিচে দেওয়া হলো:

  • পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ।
  • কংস নদী।
  • ভোগাই নদী।
  • কর্ণঝরা নদী।
  • চেল্লাখালি নদী।
  • ঝিনাই নদী।
  • মহারশি নদী।
  • সোমেশ্বরী নদী।
  • মিরগী নদী।
  • মালিঝি নদী।

উল্লেখ্য: খলং ও কালাগাঙ বর্তমানে মৃত নদী।

প্রশাসনিক বিভাজন

শেরপুর জেলা ৫টি উপজেলা, ৪টি পৌরসভা ও ৫২টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত।

উপজেলাসমূহ:

  • শেরপুর সদর।
  • ঝিনাইগাতী।
  • নকলা।
  • নালিতাবাড়ী।
  • শ্রীবরদী।

জনসংখ্যা

  • মোট জনসংখ্যা: ২৬,৩৬,১৬২ জন।
  • খানার সংখ্যা: ৩,৭২,৯৬৪ টি।

ধর্ম ও উপাসনালয়

  • মসজিদ: ১,৭৪৯টি।
  • মন্দির: ৫৮টি।
  • গির্জা: ২৯টি।
  • মাজার: ১৫টি।
  • ঈদগাহ মাঠ: ১৭৫টি।

উল্লেখযোগ্য মসজিদ:

  • মাইসাহেবা জামে মসজিদ।
  • শেরপুর জেলা মডেল মসজিদ।
  • কামারের চর বাজার মসজিদ।
  • নলবাইদ নয়াপাড়া জামে মসজিদ।

শিক্ষা

জেলায় সরকারি, বেসরকারি ও মাদ্রাসাসহ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

  • শ্রীবরদী ইসলামিয়া কামিল(মাস্টার্স) মাদ্রাসা।
  • ফতেহপুর এস. এফ. এম. কে. ফাজিল মাদ্রাসা।
  • শ্রীবরদী এ.পি.পি.আই.।
  • উত্তর শ্রীবরদী মহিলা দাখিল মাদ্রাসা।
  • জমশেদ আলী মেমোরিয়াল কলেজ।
  • শেরপুর সরকারী টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ।
  • কামারের চর পাবলিক ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা।
  • গোপালখিলা উচ্চ বিদ্যালয়।
  • বনগাঁও জনতা উচ্চ বিদ্যালয়।
  • গৌরীপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
  • শেরপুর সরকারি কলেজ।
  • শেরপুর সরকারী মহিলা কলেজ।
  • শেরপুর সরকারী ভিক্টোরিয়া একাডেমী।
  • শেরপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
  • শেরপুর পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট।
  • ডা.আলহাজ্ব সেকান্দর আলী কলেজ।
  • শ্রীবরদী সরকারি কলেজ।
  • কামারের চর পাবলিক উচ্চ বিদ‍্যালয়।
  • নকলা সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।
  • গাজীর খামার উচ্চ বিদ্যালয়।
  • নয়াবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়।
  • মাওলানা হাফিজ উদ্দিন ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি(ই-ক্যাম্পাস, প্রস্তাবিত), শ্রীবরদী।
  • নবারুণ পাবলিক স্কুল।
  • কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, শেরপুর।

বিখ্যাত খাবার

ছানার পায়েস (রসমালাই)

শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষের মিষ্টান্ন। এটি ২০২৪ সালে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। শেরপুর শহরের চারু সুইটস ও প্রেমানন্দ গ্র্যান্ড সন্সসহ বিভিন্ন দোকানে এটি পাওয়া যায়।

গুলগুলি

বেসন, ময়দা, নারকেল ও চিনি দিয়ে তৈরি জনপ্রিয় মিষ্টান্ন। বিশেষ করে ঝিনাইগাতী উপজেলার রাংটিয়া এলাকার গুলগুলি অত্যন্ত খ্যাতি অর্জন করেছে।

দর্শনীয় স্থান

  • গজনী অবকাশ কেন্দ্র।
  • মধুটিলা ইকোপার্ক।
  • বঙ্গবন্ধু পার্ক।
  • আড়াই আনী, পৌনে তিন আনী ও নয়আনী জমিদার বাড়ি।
  • নয়আনী বাজার নাটমন্দির ও রংমহল।
  • গড়জরিপা ফোর্ট (১৪৮৬-৯১ খ্রিষ্টাব্দ)।
  • শাহ কামাল ও শের আলী গাজীর মাজার।
  • নালিতাবাড়ির রাবারড্যাম।
  • অর্কিড পর্যটন কেন্দ্র।
  • বারোমারী গীর্জা।
  • রাজার পাহাড় ও পানিহাটা-তারানি পাহাড়।
  • বেড় শিমুল গাছ (নকলা)।
  • মাইসাহেবা জামে মসজিদ।
  • নানাী বাড়ি রিসোর্ট ও পরীর বাড়ি।
  • মাইসাহেবা মসজিদ।

অর্থনীতি

শেরপুরের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর।
প্রধান ফসল: ধান, পাট, গম, সরিষা, আলু, বাদাম, আখ, ডাল ও সবজি।
প্রধান ফল: কলা, আম, জাম, নারিকেল, খেজুর, কাঁঠাল, বেল, পেঁপে, কামরাঙ্গা ইত্যাদি।
জেলায় মাছচাষও ব্যাপক। রুই, কাতলা, বোয়াল, পাবদা, তেলাপিয়া, কার্পসহ নানা প্রজাতির মাছ উৎপন্ন হয়। অকৃষি খাতে ধানচাতাল, ছোট শিল্প, পশুপালন ও পরিবহন খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

স্বাস্থ্যব্যবস্থা

  • জেলা সদর হাসপাতাল: ১টি।
  • উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স: ৫টি।
  • পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র: ৫২টি।
  • গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র: ২টি।
  • মাতৃমঙ্গল ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র: ১টি।
  • ডায়াবেটিক সেন্টার: ১টি।
  • মিশন হাসপাতাল: ১টি।
  • বেসরকারি ক্লিনিক: ২টি।

সংস্কৃতি ও সংগঠন

শেরপুরে ৯৩টি ক্লাব, ১৫টি নাট্যদল, ৫টি সাহিত্য সমিতি, ৪টি গণগ্রন্থাগার, ১৩টি সিনেমা হল, ১টি শিল্পকলা একাডেমি ও ১টি শিশু একাডেমি রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান জেলার সাংস্কৃতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

উপসংহার

শেরপুর জেলা তার ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধ ইতিহাসের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। গজনী পাহাড়, মধুটিলা ইকোপার্ক, ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন ও অতিথিপরায়ণ মানুষ শেরপুরকে করে তুলেছে এক অনন্য জেলা। ইতিহাস, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে শেরপুর নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের এক আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্য।

FAQ

১. শেরপুর জেলা কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?

১৯৮৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি।

২. শেরপুরের পূর্ব নাম কী ছিল?

দশ কাহোনিয়া।

৩. শেরপুরের বিখ্যাত খাবার কী?

ছানার পায়েস ও গুলগুলি।

৪. শেরপুর জেলার প্রধান নদী কোনটি?

পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ।

৫. শেরপুরের প্রধান দর্শনীয় স্থান কোনগুলো?

গজনী অবকাশ কেন্দ্র, মধুটিলা ইকোপার্ক, বঙ্গবন্ধু পার্ক, গড়জরিপা ফোর্ট ও রাবারড্যাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *