
লালমনিরহাট জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। এটি সীমান্তবর্তী একটি জেলা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নদ-নদী, কৃষি ও ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত।
অবস্থান ও আয়তন
অবস্থান: লালমনিরহাট জেলা বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত। এটি রংপুর বিভাগের একটি অংশ।
আয়তন: জেলার মোট আয়তন ১,২৪৭.৩৭ বর্গকিলোমিটার (৪৮১.৬১ বর্গমাইল)।
জনসংখ্যা
- মোট জনসংখ্যা: ১২,৫৬,০৯৯ জন
- পুরুষ: ৬২৮,৭৯৯ জন
- মহিলা: ৬২৭,৩০০ জন
- জনসংখ্যার ঘনত্ব: প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১০০০ জন
- ভাষা: বাংলা
- ধর্ম: মুসলিম প্রধান
ইতিহাস
লালমনিরহাটের নামকরণ নিয়ে বেশ কিছু মত প্রচলিত আছে। বলা হয়ে থাকে, এক সময় এ অঞ্চলে লাল পাথর পাওয়া যেত, সেখান থেকেই নাম হয় “লালমনি”। আরেকটি মতে, ১৭৮৩ সালে কৃষক বিদ্রোহের নেতা লালমনি নামে এক নারী কৃষক নূরুলদিনের সঙ্গে মিলে ব্রিটিশ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবন উৎসর্গ করেন। তাঁর স্মরণে এলাকাটির নাম হয় “লালমনি”, পরবর্তীতে হাট বসার কারণে নাম হয় “লালমনিরহাট”।
নামকরণ
লালমনিরহাট জেলার নামকরণের দুটি প্রচলিত মত রয়েছে —
- কৃষক নেত্রী লালমনির নামে
১৭৮৩ সালে কৃষক নেত্রী লালমনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনে শহীদ হন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই এলাকার নাম রাখা হয় লালমনি, পরবর্তীতে “হাট” যুক্ত হয়ে হয় লালমনিরহাট।
- লালমনি’ নামের হাট থেকে
আরেক মতে, কুড়িগ্রাম জেলার পুরানো একটি হাটের নাম ছিল লালমনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই হাটের নাম থেকেই পুরো এলাকার নাম হয়ে যায় “লালমনিরহাট”।
বিখ্যাত খাবার
লালমনিরহাট জেলার খাবারে রয়েছে ঐতিহ্য ও স্বাদের মেলবন্ধন। এখানকার জনপ্রিয় খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছে —
- সিদল ভর্তা: শুঁটকি, মরিচ ও মসলা বেটে তৈরি ভর্তা।
- ডিমের চেংরা ভাজি: ডিম ও চিঁড়া দিয়ে তৈরি স্থানীয় খাবার।
- টাকি মাছের নাকরি ছানা: টাকি মাছ সংরক্ষণের ঐতিহ্যবাহী উপায় ও জনপ্রিয় খাবার।
- হাড়িভাঙ্গা আম: বাংলাদেশের অন্যতম সেরা আম, যার জন্য লালমনিরহাট বিখ্যাত।
- তামাক ও আখ: কৃষিজ উৎপাদনের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ফসল।
প্রশাসনিক এলাকা
লালমনিরহাট জেলায় মোট ৫টি উপজেলা রয়েছে —
- লালমনিরহাট সদর।
- আদিতমারী।
- কালীগঞ্জ।
- হাতীবান্ধা।
- পাটগ্রাম।
প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা
লালমনিরহাট জেলার উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো হলো —
- নিদারিয়া মসজিদ (বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর তালিকাভুক্ত)।
- সাহাবায়ে কেরাম জামে মসজিদ (৬৯ হিজরি / ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দ)।
দর্শনীয় স্থান
লালমনিরহাট জেলার দর্শনীয় স্থানগুলো হলো —
- ৬৯ হিজরীর হারানো মসজিদ।
- তিস্তা ব্যারেজ।
- তিস্তা সড়ক ও রেল সেতু।
- তিনবিঘা করিডোর।
- লালমনিরহাট রেলওয়ে স্টেশন।
- কবি শেখ ফজলুল করিমের বসতভিটা, কালীগঞ্জ।
- কাকিনা জমিদার বাড়ি।
- তুষভাণ্ডার জমিদার বাড়ি।
- এক উঠানে মসজিদ ও মন্দির (পুরানবাজার, কালিবাড়ি)।
- বুড়িমারী স্থলবন্দর জিরো পয়েন্ট।
- ভূমি গবেষণা জাদুঘর, পাটগ্রাম।
- শালবন।
- এক কাতার মসজিদ।
- মোগলহাট রেলবন্দর (বিলুপ্ত)।
শিক্ষা
লালমনিরহাট জেলার শিক্ষার হার প্রায় ৫৫.৬৫%।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা
- বিশ্ববিদ্যালয়: ১টি।
- কলেজ: ৩৫টি।
- মাধ্যমিক বিদ্যালয়: ১৬৩টি।
- নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়: ৪৩টি।
- মাদ্রাসা: ৭৮টি।
- প্রাথমিক বিদ্যালয়: ৭৫৪টি।
- পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট: ৩টি।
- টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট: ১টি।
- টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ: ১টি।
- কিন্ডারগার্টেন: প্রায় ২০০টি।
উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়।
- লালমনিরহাট সরকারি কলেজ।
- সরকারি আলিমুদ্দিন কলেজ।
- আদিতমারী সরকারি কলেজ।
- মজিদা খাতুন সরকারি মহিলা কলেজ।
- পাটগ্রাম সরকারি কলেজ।
- হাতীবান্ধা এস.এস. সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়।
- কবি শেখ ফজলুল করিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
- লালমনিরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
- লালমনিরহাট নেছারিয়া কামিল মাদরাসা।
অর্থনীতি
লালমনিরহাট একটি কৃষি প্রধান জেলা।
- কৃষিকাজে নিয়োজিত: ৭২.৭৮%
- ব্যবসায়ী: ১০.৪৯%
- শ্রমিক: ৩.৪৬%
- চাকরিজীবী: ৪.৪৫%
প্রধান অর্থনৈতিক ফসল: ধান, গম, আখ, তামাক, পাট, ভুট্টা, সবজি ইত্যাদি।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
লালমনিরহাট জেলায় সড়ক, রেল ও আকাশপথ— তিন মাধ্যমেই যোগাযোগ ব্যবস্থা বিদ্যমান।
- বাস, ট্রেন, রিকশা, অটো রিকশা ও ভ্যান সাধারণ পরিবহন ব্যবস্থা।
- এখানে একটি প্রাচীন বিমানবন্দরও রয়েছে, যা বর্তমানে ঐতিহাসিক নিদর্শন।
স্বাস্থ্য
জেলায় সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
- লালমনিরহাট সদর হাসপাতাল।
- পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
- কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
- হাতীবান্ধা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
- আদিতমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান
বিভিন্ন ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বিশেষায়িত হাসপাতাল স্বাস্থ্যসেবায় ভূমিকা রাখছে।
নদ-নদী
লালমনিরহাট জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত প্রধান নদীগুলো হলো —
- তিস্তা নদী।
- ধরলা নদী।
- সতী নদী।
- সানিয়াজান নদী।
- সিংগিমারী নদী।
- ত্রিমোহনী নদী।
- গিরীধারী নদী।
- ভাটেশ্বরী নদী।
- মালদহ নদী।
- স্বর্ণামতি নদী।
- রত্নাই নদী।
উপসংহার
লালমনিরহাট জেলা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের এক মনোরম প্রাকৃতিক ও ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল। তিস্তা নদী, কৃষি, ঐতিহাসিক স্থাপনা ও সংস্কৃতির জন্য লালমনিরহাট বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। এটি উত্তরবঙ্গের একটি প্রাণবন্ত জেলা, যা প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের মিলনে গড়ে উঠেছে এক অনন্য সৌন্দর্যে।
FAQ
১. লালমনিরহাট জেলা কোথায় অবস্থিত?
লালমনিরহাট জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে, রংপুর বিভাগের অন্তর্গত এবং এটি ভারতের সীমান্তবর্তী একটি জেলা।
২. লালমনিরহাট জেলার নামকরণ কেন লালমনিরহাট হলো?
১৭৮৩ সালে কৃষক নেত্রী লালমনি ব্রিটিশ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তাঁর নামানুসারে জেলার নাম হয় “লালমনিরহাট”।
৩. লালমনিরহাট জেলার প্রধান নদী কোনটি?
তিস্তা নদী লালমনিরহাট জেলার প্রধান নদী, এছাড়াও ধরলা ও সতী নদী উল্লেখযোগ্য।
৪. লালমনিরহাট জেলার বিখ্যাত খাবার কী কী?
জেলার জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে রয়েছে সিদল ভর্তা, ডিমের চেংরা ভাজি, টাকি মাছের নাকরি ছানা এবং বিখ্যাত হাড়িভাঙ্গা আম।
৫. লালমনিরহাট জেলার দর্শনীয় স্থান কী কী?
তিস্তা ব্যারেজ, তিনবিঘা করিডোর, কাকিনা জমিদার বাড়ি, কবি শেখ ফজলুল করিমের বসতভিটা এবং হারানো মসজিদ দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত।



