ময়মনসিংহ জেলা

ময়মনসিংহ জেলা পরিচিতি ও তথ্য

ময়মনসিংহ জেলা বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশাসনিক অঞ্চল এবং ময়মনসিংহ বিভাগের সদর জেলা। অবস্থানগত কারণে এটি দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিনির্ভর ও ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল। জেলার পূর্ব নাম ছিল “মোমেনশাহী” ও “নাসিরাবাদ”।

ধান উৎপাদনে ময়মনসিংহ বাংলাদেশের শীর্ষস্থানে রয়েছে, পাশাপাশি এখানে মাছ চাষও ব্যাপকভাবে হয়। মুক্তাগাছার মণ্ডা, ভাওয়াল বনাঞ্চল, গারো পাহাড় ও প্রাচীন জমিদারবাড়ির জন্য এ জেলা সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের ধারক। ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন আয়তনে দেশের সপ্তম এবং জনসংখ্যায় অষ্টম বৃহত্তম মহানগর।

ইতিহাস

ময়মনসিংহ বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন জেলা। ১৭৮৭ সালের ১ মে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনিক প্রয়োজন মেটাতে এই জেলা গঠন করা হয়। প্রথমে সদর দপ্তর স্থাপিত হয় বেগুনবাড়ির কোম্পানিকুঠিতে, পরে ১৭৯১ সালে স্থানান্তরিত হয় সেহড়া মৌজায়।

ব্রিটিশ আমলে জেলার বিভিন্ন অঞ্চল ক্রমান্বয়ে পৃথক জেলায় উন্নীত হয়। ১৮৪৫ সালে জামালপুর, ১৮৬০ সালে কিশোরগঞ্জ, ১৮৬৯ সালে টাঙ্গাইল ও ১৮৮২ সালে নেত্রকোণা মহকুমা গঠিত হয়। পরবর্তীতে এসব মহকুমা স্বাধীন জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

১৮১১ সালে ময়মনসিংহ শহর প্রতিষ্ঠিত হয়, যার জমি দান করেন মুক্তাগাছার জমিদার রঘুনন্দন আচার্য। ১৮৮৬ সালে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ চালু হয়, যা উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা ঘটায়।

নামকরণ

মোগল আমলে “মোমেনশাহ” নামের এক সুফি সাধকের নামানুসারে অঞ্চলটির নাম হয় মোমেনশাহী”। পরবর্তীতে বাংলার সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তাঁর পুত্র সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত হের নামে এ অঞ্চলের নাম দেন “নাসিরাবাদ” বা “নসরতশাহী”।

ব্রিটিশ আমলে প্রশাসনিক বিভ্রান্তি ও রেলপথ সংক্রান্ত ভুল বোঝাবুঝির কারণে “নাসিরাবাদ” নাম পরিবর্তিত হয়ে “ময়মনসিংহ” হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, একসময় মোঘল সেনাপতি মনমোহন সিংহ ঈসা খাঁর বিরুদ্ধ অভিযানে এই এলাকায় অবস্থান করেন, তার নাম থেকেই “ময়মনসিংহ” নামটির উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়।

অবস্থান ও আয়তন

ময়মনসিংহ জেলার উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে গাজীপুর জেলা, পূর্বে নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ জেলা, এবং পশ্চিমে শেরপুর, জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলা অবস্থিত। এটি ভৌগোলিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তবর্তী জেলা এবং ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা সমৃদ্ধ।

ঐতিহ্যবাহী খাবার

  • মুক্তাগাছার মণ্ডা।
  • জাকির মিয়ার টক জিলাপি।
  • কাঠকচুর বড়া।
  • চেপা শুটকির পুলি।

প্রশাসনিক কাঠামো

ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনিকভাবে ১টি সিটি কর্পোরেশন, ১৩টি উপজেলা, ১৪টি থানা, ১০টি পৌরসভা, ১৪৭টি ইউনিয়ন, ২১০১টি মৌজা, ২৭০৯টি গ্রাম ও ১১টি সংসদীয় আসন নিয়ে গঠিত।

উপজেলা তালিকা

  • ময়মনসিংহ সদর।
  • ভালুকা।
  • ফুলবাড়ীয়া।
  • ত্রিশাল।
  • গফরগাঁও।
  • নান্দাইল।
  • ঈশ্বরগঞ্জ।
  • ফুলপুর।
  • ধোবাউড়া।
  • হালুয়াঘাট।
  • মুক্তাগাছা।
  • গৌরীপুর।
  • তারাকান্দা।

নদ-নদী

ময়মনসিংহ জেলা একটি নদীসমৃদ্ধ অঞ্চল। জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বহু নদী কৃষি, মৎস্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জেলার প্রধান নদীগুলো হলো:

  • পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী।
  • মঘা নদী।
  • কংস নদী।
  • নরসুন্দা নদী।
  • মগড়া নদী।
  • দইনা নদী।
  • খিরু নদী।
  • সুতিয়া নদী।
  • সুরিয়া নদী।
  • পাগারিয়া নদী।
  • বানার নদী।
  • কাওরাইদ নদী।
  • বাথাইল নদী।
  • ভোগাই নদী।
  • বাজান নদী।
  • নিতাই নদী।
  • মালিজি নদী।
  • ধলাই নদী।
  • নাগেশ্বরী নদী।
  • সিরখালি নদী।
  • বাজুয়া নদী।
  • মাহারী নদী।

শিক্ষা ব্যবস্থা

ময়মনসিংহ জেলা শিক্ষার জন্য সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী। এখানে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কৃষি ও চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ

  • বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
  • জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
  • ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ।
  • আনন্দ মোহন কলেজ।
  • মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ।
  • ময়মনসিংহ জিলা স্কুল।
  • বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
  • ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
  • ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ।
  • নাসিরাবাদ কলেজ।
  • কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।
  • শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন চারুকলা ইনস্টিটিউট।
  • ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।
  • ময়মনসিংহ সরকারি কলেজ।

দর্শনীয় স্থান

ময়মনসিংহ তার ঐতিহাসিক স্থাপনা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য সুপরিচিত।

প্রধান দর্শনীয় স্থানসমূহ

  • মুক্তাগাছার রাজবাড়ী।
  • আলেকজান্ডার ক্যাসল।
  • শশী লজ।
  • ময়মনসিংহ জাদুঘর।
  • বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
  • শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা।
  • বৈলর জমিদার বাড়ি।
  • পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ।
  • কাদিগড় জাতীয় উদ্যান।
  • বোটানিক্যাল গার্ডেন।
  • আলাদিন’স পার্ক।
  • তেপান্তর শুটিং স্পট।
  • গারো পাহাড়।
  • চীনা মাটির টিলা।
  • নজরুল স্মৃতি যাদুঘর।
  • মুক্তাগাছার মণ্ডার কারখানা।

ভাষা

ময়মনসিংহ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা বাংলা ভাষার ভাটি উপভাষার অন্তর্গত। এই ভাষায় ‘টান-টোন’ উচ্চারণ ও স্বরভঙ্গি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তৎসম শব্দের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম, পরিবর্তে তদ্ভব ও দেশীয় শব্দের ব্যবহার বেশি। এ অঞ্চলের আঞ্চলিক শব্দভাণ্ডার বাংলা ভাষার মূলধারায়ও প্রভাব ফেলেছে, যা ভাষার গতিশীলতার প্রমাণ।

সংস্কৃতি ও লোকজ ঐতিহ্য

ময়মনসিংহ বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র। বিখ্যাত “ময়মনসিংহ গীতিকা” এই অঞ্চলের লোকজ ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন, যা বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

প্রধান লোকসঙ্গীত ও উৎসবসমূহের মধ্যে রয়েছে:

 বাউল গান, ভাটিয়ালী, কিস্সাপালা, কবিগান, কীর্তন, সারিগান, মুর্শিদী, জারিগান, ঢপযাত্রা, ধান কাটার গান, বারোমাসী, পালকির গান ইত্যাদি। এ অঞ্চলে বাঙালি, গারো, হাজং ও কোচ জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও উৎসব নিয়ে বসবাস করে।

চিকিৎসা ব্যবস্থা

ময়মনসিংহ জেলার প্রধান স্বাস্থ্যকেন্দ্র হলো ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, যা একটি ১০০০ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া প্রতিটি উপজেলায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে।

উল্লেখযোগ্য হাসপাতালসমূহ

  • ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
  • ডেলটা হেলথ কেয়ার।
  • পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
  • উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স (ভালুকা, ফুলপুর, ঈশ্বরগঞ্জ, নান্দাইল, ত্রিশাল, মুক্তাগাছা ইত্যাদি)।

যোগাযোগ ব্যবস্থা

ময়মনসিংহের যোগাযোগব্যবস্থা সড়ক ও রেলপথনির্ভর।

সড়ক যোগাযোগ

  • ঢাকা-ময়মনসিংহ জাতীয় সড়ক দেশের অন্যতম ব্যস্ত সড়ক।
  • নিয়মিত এসি ও নন-এসি বাস সার্ভিস ঢাকা ও অন্যান্য শহর থেকে চলাচল করে।
  • জেলার অভ্যন্তরে সড়ক যোগাযোগ উন্নত এবং উপজেলা পর্যায়ে সিএনজি, অটোরিকশা ও বাস ব্যবহৃত হয়।

রেল যোগাযোগ

  • ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রেল সংযোগ।
  • ময়মনসিংহ রেলস্টেশন থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরাসরি ট্রেন চলাচল করে।

নৌ ও আকাশ যোগাযোগ

  • জেলার কিছু স্থানে স্থানীয় নদীপথে সীমিত নৌ যোগাযোগ রয়েছে।
  • নিকটবর্তী বিমানবন্দর হলো ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।

উপসংহার

ময়মনসিংহ জেলা বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও কৃষিতে এক সমৃদ্ধ অধ্যায়ের প্রতীক। এটি শুধু প্রশাসনিকভাবে নয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঐতিহ্যবাহী মেলা ও জমিদারবাড়িগুলো জেলা সম্পর্কে একটি অনন্য পরিচয় বহন করে।

একদিকে গারো পাহাড় ও ব্রহ্মপুত্রের বুকে জেগে থাকা জীবনের ছন্দ, অন্যদিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের ঐতিহ্য—সব মিলিয়ে ময়মনসিংহ আজ আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মিলনস্থল হিসেবে বাংলাদেশের মানচিত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে।

FAQ

১. ময়মনসিংহ জেলা কখন প্রতিষ্ঠিত হয়?

১৭৮৭ সালের ১ মে ময়মনসিংহ জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়।

২. ময়মনসিংহ জেলার পুরোনো নাম কী ছিল?

 জেলার পূর্ব নাম ছিল “মোমেনশাহী” ও “নাসিরাবাদ”।

৩. ময়মনসিংহ জেলার বিখ্যাত খাবার কী?

মুক্তাগাছার মণ্ডা ও জাকির মিয়ার টক জিলাপি।

৪. জেলাটির প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনটি?

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, যা দেশের প্রাচীনতম কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

৫. ময়মনসিংহে প্রধান পর্যটন আকর্ষণ কী কী?

মুক্তাগাছার রাজবাড়ী, শশী লজ, আলেকজান্ডার ক্যাসল ও কাদিগড় জাতীয় উদ্যান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *