
পাবনা জেলা বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী ও গুরুত্বপূর্ণ জেলা। এটি তাঁত শিল্প, মানসিক হাসপাতাল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং সমৃদ্ধ কৃষি অর্থনীতির জন্য বিখ্যাত। পদ্মা, যমুনা, আত্রাই ও বড়াল নদীর মিলনভূমি এই জেলা প্রাচীন বরেন্দ্র ও বঙ্গ জনপদের অংশ ছিল।
নামকরণ
পাবনা নামের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে।
- প্রত্নতাত্ত্বিক কানিংহামের মতে, প্রাচীন “পুন্ড্রবর্ধন” রাজ্যের নাম থেকেই “পাবনা” নামটি এসেছে।
- কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, “পদুম্বা” নামক জনপদ থেকে ধ্বনিগত পরিবর্তনে “পাবনা” হয়েছে।
- আবার কেউ কেউ বলেন, একসময় এই অঞ্চলে “পাবন” নামের এক দস্যুর আস্তানা ছিল, তার নাম থেকেই “পাবনা” নামের উৎপত্তি।
- আরেকটি মতে, “গঙ্গার পাবনী” নামের একটি নদীর স্রোতধারা থেকেই “পাবনা” নাম এসেছে।
ইতিহাস
১৮২৮ সালের ১৬ অক্টোবর পাবনা স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে ঘোষিত হয়।
এর আগে অঞ্চলটি রাজশাহী জেলার অংশ ছিল। পরবর্তীতে যশোর জেলার কিছু থানা যুক্ত করে নতুন জেলা গঠন করা হয়।
- ১৮৩২ সালে এটি ডিপুটি কালেক্টর দ্বারা পরিচালিত হয়।
- ১৮৫৯ সালে প্রথম কালেক্টর নিযুক্ত করা হয়।
- ১৮৬৯ সালে সিরাজগঞ্জ ও ১৮৭৬ সালে পাবনায় পৌরসভা গঠিত হয়।
- ১৮৮৫ সালে জেলা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ১৮৫৭ সালে টি. ই. রেভেন্স ছিলেন জেলার প্রথম প্রশাসক।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাবনা টাউন হল ময়দানে বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করা হয়।
অবস্থান ও আয়তন
পাবনা জেলা বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত।
- অক্ষাংশ: ২৩°৪৮′ – ২৪°৪৭′ উত্তর
- দ্রাঘিমাংশ: ৮৯°০২′ – ৮৯°৫০′ পূর্ব
সীমানা:
- উত্তরে: নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলা
- দক্ষিণে: পদ্মা নদী, রাজবাড়ী ও কুষ্টিয়া জেলা
- পূর্বে: মানিকগঞ্জ জেলা ও যমুনা নদী
- পশ্চিমে: পদ্মা নদী ও নাটোর জেলা
জনসংখ্যা (২০২২ সালের তথ্য)
- মোট জনসংখ্যা: ২৯,০৯,৬২৪ জন
- পুরুষ: ১৪,৫০,২২৫
- নারী: ১৪,৫৯,২৮৪
- হিজরা: ১১৫
- ধর্ম অনুযায়ী:
- মুসলিম: ৯৫.১২%
- হিন্দু: ৪.৫০%
- খ্রিস্টান: ০.২২%
- অন্যান্য: ০.১৬%
নদ-নদী
পাবনা নদীবিধৌত একটি সমৃদ্ধ জনপদ। প্রধান নদীগুলো হলো—
পদ্মা
- যমুনা নদী।
- ইছামতি নদী।
- আত্রাই নদী।
- বড়াল নদী।
- কাগেশ্বরী নদী।
- গুড় নদী।
- গুমানি নদী।
- চিকনাই নদী।
- বাদাই ও হুরাসাগর নদী।
ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান
- হার্ডিঞ্জ ব্রীজ ও লালন শাহ সেতু।
- রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
- পাবনা মানসিক হাসপাতাল।
- ঈশ্বরদী বিমানবন্দর।
- ভাঁড়ারা শাহী মসজিদ।
- তাড়াশ ভবন।
- জোড় বাংলা মন্দির।
- চলনবিল।
- গাজনার বিল।
- চাটমোহর শাহী মসজিদ।
- অনুকূলচন্দ্র আশ্রম।
- আজিম চৌধুরীর জমিদার বাড়ি।
- চাকীবাড়ি জমিদার বাড়ি।
- শিতলাই জমিদার বাড়ি।
- ক্ষেতুপাড়া জমিদার বাড়ি।
- কাচারীপাড়া জামে মসজিদ।
- বীর বাঙালি স্মৃতি ভাস্কর্য।
- কাঞ্চন পার্ক, রূপকথা ইকো পার্ক ও রিসোর্ট।
অর্থনীতি
পাবনা জেলার অর্থনীতি কৃষিনির্ভর হলেও শিল্পকারখানা ও হোসিয়ারি শিল্প এ জেলার গর্ব।
প্রধান কৃষি ফসল: ধান, পাট, গম, পেঁয়াজ, লিচু, আম, সবজি ও চলনবিলের মাছ।
গুরুত্বপূর্ণ শিল্প প্রতিষ্ঠান
- স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।
- স্কয়ার কনজুমার প্রডাক্ট লিমিটেড।
- পাবনা চিনিকল।
- রহিম আফরোজ গ্লোব্যাট লিমিটেড।
- বেঙ্গল মিট।
- আকিজ জুট মিল।
- প্রাণ এগ্রো ফুড লি.।
- ঈশ্বরদী ইপিজেড।
- উত্তরবঙ্গ কাগজকল।
চিকিৎসা কেন্দ্র
সরকারি হাসপাতাল:
- ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল।
- পাবনা মানসিক হাসপাতাল।
- সমাজ সেবা সদর হাসপাতাল।
- পাবনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
বেসরকারি হাসপাতাল:
- ডা. মাহফুজ ইমারজেন্সি সেন্টার।
- শিমলা হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
- পপুলার জেনারেল হাসপাতাল।
- সেন্ট্রাল হাসপাতাল।
- ল্যাব ওয়ান মেডিকেল সেন্টার।
- আল-আমিন ক্লিনিক।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
- পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
- পাবনা মেডিকেল কলেজ।
- পাবনা ক্যাডেট কলেজ।
- সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ।
- সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজ।
- পাবনা সরকারি মহিলা কলেজ।
- পাবনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
- পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।
- ঈশ্বরদী সরকারি কলেজ।
- পাবনা জিলা স্কুল।
- পাবনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
- সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ।
- সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
- কাজিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়।
- উলাট সিদ্দিকিয়া ফাজিল মাদ্রাসা।
- পাবনা আলিয়া মাদ্রাসা।
- পুষ্পপাড়া কামিল মাদ্রাসা।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
সড়কপথ:
ঢাকা-পাবনা দূরত্ব প্রায় ২০৮ কিলোমিটার (ঢাকা → টাঙ্গাইল → সিরাজগঞ্জ → পাবনা)।
রেলপথ:
ঈশ্বরদী জংশন রেলওয়ে স্টেশন দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রেল জংশন।
ঢালারচর এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি এই জেলার নতুন রেলপথে চলাচল করে।
নৌপথ:
আরিচা ঘাট থেকে কাজিরহাট হয়ে লঞ্চ ও স্পিডবোটে পাবনা যাওয়া যায়।
আকাশপথ:
ঈশ্বরদী বিমানবন্দর বর্তমানে বন্ধ থাকলেও পূর্বে এটি উত্তরবঙ্গের প্রধান বিমানবন্দর ছিল।
প্রশাসনিক অঞ্চল
পাবনা জেলা ৯টি উপজেলায় বিভক্ত:
- পাবনা সদর।
- ঈশ্বরদী।
- চাটমোহর।
- আটঘরিয়া।
- ফরিদপুর।
- সাঁথিয়া।
- ভাঙ্গুড়া।
- বেড়া।
- সুজানগর।
পাবনা জেলার বিখ্যাত খাবার
- প্যারা সন্দেশ: পাবনার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি, সারা দেশে জনপ্রিয়।
- খাঁটি ঘি: পাবনার ঘি বেড়া, সাঁথিয়া ও শাহজাদপুর অঞ্চলে বিশেষভাবে তৈরি হয়।
- ঈশ্বরদীর লিচু: এখানকার লিচু অত্যন্ত সুস্বাদু ও বিখ্যাত।
- চলনবিলের মাছ: পাবনার অর্থনীতি ও খাদ্য সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য
পাবনা লোকসংগীত, পালাগান, লোকনৃত্য ও গ্রামীণ নাট্য সংস্কৃতির জন্য সুপরিচিত।
এ জেলার মানুষ অতিথিপরায়ণ, পরিশ্রমী এবং সংস্কৃতিপ্রিয়।
উপসংহার
পাবনা জেলা তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব, শিল্প উন্নয়ন, কৃষি সম্ভাবনা এবং সংস্কৃতির ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এক অনন্য জনপদ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মানসিক হাসপাতাল, তাঁত শিল্প, ঘি ও প্যারা সন্দেশ — সবকিছু মিলিয়ে পাবনা আজ বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক।
FAQ
১. পাবনা জেলা কোথায় অবস্থিত?
পাবনা জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে রাজশাহী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। এটি যমুনা নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত।
২. পাবনা জেলার আয়তন কত?
পাবনা জেলার মোট আয়তন প্রায় ২৩৭১.৫০ বর্গ কিলোমিটার।
৩. পাবনা জেলার প্রধান শিল্প কী?
পাবনা জেলার প্রধান শিল্প হলো তাঁতশিল্প, কৃষিভিত্তিক শিল্প এবং ওষুধ শিল্প (এখানে স্কয়ার, ইনসেপটা, এসকেএফ-এর মতো বড় ওষুধ কোম্পানির কারখানা রয়েছে)।
৪. পাবনা জেলার ঐতিহাসিক স্থানগুলো কী কী?
ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে হেমায়েতপুরের সৎসঙ্গ আশ্রম, চাটমোহরের কাচারী ভবন, পাবনা পুরাতন টাউন হল, এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকা।
৫. পাবনা জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব কারা?
বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্যকার মমতাজ উদ্দিন আহমদ, অভিনেতা আমজাদ হোসেন এবং শিক্ষাবিদ আহমদ শরীফ।
৬. পাবনা জেলার বিখ্যাত খাবার কী?
পাবনা জেলার বিখ্যাত খাবারের মধ্যে রয়েছে চাটমোহরের ছানার সন্দেশ ও ঐতিহ্যবাহী দুধের মিষ্টি।



