
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত নাটোর জেলা, রাজশাহী বিভাগের একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ জনপদ। জেলার উত্তরে নওগাঁ ও বগুড়া, দক্ষিণে পাবনা ও কুষ্টিয়া, পূর্বে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ, এবং পশ্চিমে রাজশাহী জেলা অবস্থিত।
অবস্থান ও আয়তন
নাটোর জেলা বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা।
- উত্তরে নওগাঁ ও বগুড়া জেলা।
- দক্ষিণে পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলা।
- পূর্বে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলা।
- পশ্চিমে রাজশাহী জেলা অবস্থিত।
জেলার আয়তন ১,৯০৫.০৫ বর্গকিলোমিটার এবং এটি আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের ৩৫তম বৃহত্তম জেলা।
নাটোর শহরটি পদ্মা-যমুনা মিলনস্থল হতে প্রায় ১০৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। গ্রিনিচ মান সময়ের চেয়ে নাটোরের সময় ৫ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট অগ্রবর্তী, আর ঢাকার সঙ্গে সময়ের ব্যবধান প্রায় ৬ মিনিট।নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার অংশ নিয়ে গঠিত চলনবিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল।
নাটোরে আরও দুটি উল্লেখযোগ্য বিল রয়েছে — হালতি বিল ও হেলেনচা বিল। বাংলাদেশে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয় নাটোরের লালপুর উপজেলায়।
সাধারণ পরিচিতি
নাটোর জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমের আটটি জেলার একটি। এটি ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং মিষ্টির জন্য প্রসিদ্ধ। নাটোর বিখ্যাত বনলতা সেন, রাণী ভবানী, নাটোর রাজবাড়ী, উত্তরা গণভবন, কাঁচাগোল্লা, চলনবিল ও হালতি বিল-এর জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।
যদিও নাটোর জেলা বড় ধরনের দুর্যোগপ্রবণ নয়, তবু সিংড়া ও লালপুর উপজেলার আত্রাই ও পদ্মা নদীতে মাঝে মাঝে বন্যা দেখা দেয়। সাধারণভাবে জেলার সব উপজেলার আবহাওয়া প্রায় একই হলেও, লালপুরে গড় তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি।
নাটোরের বিখ্যাত খাবার
কাঁচাগোল্লা
নাটোরের সবচেয়ে বিখ্যাত মিষ্টিজাতীয় খাবার। এটি দুধের কাঁচা ছানা দিয়ে তৈরি, যা স্বাদ ও তৈরির পদ্ধতিতে অন্য মিষ্টি থেকে আলাদা।
কলা
নাটোরের কলা সুস্বাদু ও দেশজুড়ে জনপ্রিয়।
চিনি
নাটোরের লালপুর উপজেলায় উৎপাদিত আখ থেকে তৈরি চিনি এখানকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পণ্য।
ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান
নাটোর রাজবাড়ী
নাটোর রাজবংশের প্রথম রাজা রাম জীবন চৌধুরী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই রাজবাড়ীটি নাটোরের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের প্রতীক।
উত্তরা গণভবন (দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি)
দিঘাপতিয়া পরগনার রাজা দয়ারাম রায়-কে উপহার দেওয়া এই রাজবাড়িটি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ও কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
দয়ারামপুর জমিদার বাড়ি
এটি একটি প্রাচীন জমিদার বাড়ি, যা নাটোরের ঐতিহাসিক স্থাপত্যের অংশ।
চৌগ্রাম জমিদার বাড়ি
নাটোরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য জমিদার বাড়ি, যা ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে পরিচিত।
বুধপাড়া কালীমন্দির
লালপুরে অবস্থিত প্রায় ৫৩০ বছরের পুরনো এই মন্দিরটি নাটোরের অন্যতম ধর্মীয় ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও অন্যান্য স্থান
- চলনবিল জাদুঘর: চলনবিল এলাকার ইতিহাস ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘর।
- হালতি বিল: সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য ও নৌবিহারের জন্য পরিচিত।
- শহীদ সাগর: নাটোর শহরের একটি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান।
চিকিৎসা ব্যবস্থা
নাটোরে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার বিস্তার ঘটেছে। উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানসমূহ:
- আধুনিক ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সদর হাসপাতাল
- ব্যাপ্টিস্ট মিড মিশন হাসপাতাল
- সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ)
- পুলিশ হাসপাতাল নাটোর
- আমজাদ খান চৌধুরী মেমোরিয়াল হাসপাতাল
- আমেনা হাসপাতাল বনপাড়া
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসমূহ
সিংড়া, লালপুর, বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, বাগাতিপাড়া, নলডাঙ্গা ও নাটোর সদর উপজেলায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থা
নাটোর শিক্ষা-সমৃদ্ধ জেলা। এখানে রয়েছে অসংখ্য স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।
সরকারি কলেজসমূহ
- নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সরকারি কলেজ
- আব্দুলপুর সরকারি কলেজ, লালপুর
- রাণী ভবানী সরকারি মহিলা কলেজ
- বিলচলন শহীদ সামসুজ্জোহা সরকারি কলেজ
- শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি মহিলা কলেজ
- নাটোর সিটি কলেজ
- দিঘাপতিয়া এম. কে. অনার্স কলেজ
- নাটোর মহিলা কলেজ
মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহ
- সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়
- সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়
- কালেক্টরেট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ
- নাটোর সুগারমিল উচ্চ বিদ্যালয়
- মহারাজা জে. এন. উচ্চ বিদ্যালয়
- নব বিধান গার্লস স্কুল
- শের ই বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়
- তেবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়
- রাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়
- পারভীন পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়সহ অসংখ্য স্কুল রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়
- ড. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
- বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
- রাজশাহী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
কারিগরি ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান
- নাটোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট
- নাটোর টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট
- নাটোর নার্সিং ইনস্টিটিউট
- প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট
- টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট (রামাইগাছি ও লালপুর)
- বিলদহর কারিগরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ
- যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (লালপুর ও সিংড়া)
- মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (সিংড়া)
- কৃষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (লালপুর)
প্রশাসনিক এলাকা
নাটোরে মোট ৭টি উপজেলা ও ২টি পৌরসভা রয়েছে।
উপজেলা সমূহ
- নাটোর সদর উপজেলা
- বাগাতিপাড়া উপজেলা
- বড়াইগ্রাম উপজেলা
- গুরুদাসপুর উপজেলা
- লালপুর উপজেলা
- সিংড়া উপজেলা
- নলডাঙ্গা উপজেলা
পৌরসভা
- নাটোর পৌরসভা
- বনপাড়া পৌরসভা
আইনশৃঙ্খলা ও পুলিশ প্রশাসন
হাইওয়ে থানা
- ঝলমলিয়া হাইওয়ে থানা
- বনপাড়া হাইওয়ে থানা
পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র
- আব্দুলপুর তদন্ত কেন্দ্র
- বনপাড়া তদন্ত কেন্দ্র
পুলিশ ফাঁড়ি
- নিচাবাজার পুলিশ ফাঁড়ি
- উপরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি
- কালীগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ি
- বামিহাল পুলিশ ফাঁড়ি
- জামনগর পুলিশ ফাঁড়ি
- ওয়ালিয়া পুলিশ ফাঁড়ি
- পালপাড়া পুলিশ ফাঁড়ি (অস্থায়ী)
- লালবাজার পুলিশ ফাঁড়ি।
রেল যোগাযোগ
নাটোর জেলায় রয়েছে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার রেললাইন, যার মাধ্যমে সারা দেশের সঙ্গে উন্নত রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। নাটোর জেলায় ১২টি রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে যথা:
রেলওয়ে স্টেশনসমূহ
- নাটোর রেলওয়ে স্টেশন
- আব্দুলপুর জংশন
- মাঝগ্রাম জংশন
- মাধনগর
- আজিমনগর
- নলডাঙ্গার হাট
- বাসুদেবপুর
- ইয়াছিনপুর
- মালঞ্চি
- লোকমানপুর
- ঈশ্বরদী বাইপাস
- বীরকুটশা স্টেশন
উপসংহারনাটোর জেলা ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল।
এই জেলার ঐতিহ্যবাহী কাঁচাগোল্লা, রাজবাড়ীগুলোর স্থাপত্য, প্রাকৃতিক চলনবিল, এবং রাণী ভবানীর স্মৃতি নাটোরকে এক অনন্য পরিচয়ে সমৃদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশের মানচিত্রে নাটোর শুধু একটি জেলা নয় — এটি ঐতিহ্যের প্রতীক, সংস্কৃতির ধারক ও গৌরবময় ইতিহাসের উত্তরাধিকারী।
(FAQ)
১. নাটোর জেলা কোথায় অবস্থিত?
নাটোর জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে রাজশাহী বিভাগে অবস্থিত। এর উত্তরে নওগাঁ ও বগুড়া, দক্ষিণে পাবনা ও কুষ্টিয়া, পূর্বে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ এবং পশ্চিমে রাজশাহী জেলা অবস্থিত।
২. নাটোর জেলার বিখ্যাত খাবার কী?
নাটোরের সবচেয়ে বিখ্যাত মিষ্টি হলো কাঁচাগোল্লা। এটি দুধের কাঁচা ছানা দিয়ে তৈরি, যা স্বাদ ও পদ্ধতিতে অনন্য। এছাড়াও নাটোরের কলা ও আখ থেকে তৈরি চিনি খুব জনপ্রিয়।
৩. নাটোর জেলার প্রধান দর্শনীয় স্থানগুলো কী কী?
নাটোরের প্রধান দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে উত্তরা গণভবন (দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী), নাটোর রাজবাড়ী, চলনবিল, হালতি বিল, বুধপাড়া কালীমন্দির এবং শহীদ সাগর।
৪. নাটোর জেলার শিক্ষা ব্যবস্থার বিশেষত্ব কী?
নাটোরে রয়েছে বহু নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেমন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সরকারি কলেজ, রাণী ভবানী মহিলা কলেজ, নাটোর সিটি কলেজ, নাটোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং ড. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
৫. নাটোর জেলার অর্থনীতি কোন ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে?
নাটোরের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। এখানে আখ, ধান, কলা এবং শাকসবজি উৎপাদন হয়। এছাড়া চিনিকল ও কৃষিভিত্তিক শিল্প এই জেলার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।



