
জামালপুর জেলা বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের ময়মনসিংহ বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চল। পূর্বে এটি “সিংহজানি” নামে পরিচিত ছিল। ইসলামের প্রচারক হযরত শাহ জামাল (র.)-এর নামে এই জেলার নামকরণ করা হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদী এবং যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত এই জেলা কৃষি, ঐতিহ্যবাহী শিল্প, এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য সমৃদ্ধ।
ইতিহাস
জামালপুর অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য হযরত শাহ জামাল (র.) ইয়েমেন থেকে ২০০ জন অনুসারীর সঙ্গে আগমন করেছিলেন। ১৮৪৫ সালে ময়মনসিংহ জেলার অধীনে জামালপুর মহকুমা গঠিত হয়। ১৯৭৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর জামালপুরকে বাংলাদেশের ২০তম জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৪ সালে জামালপুর জেলা থেকে শেরপুর জেলা আলাদা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালে জামালপুরে পাকিস্তানি সেনা ও স্থানীয় রাজাকারদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র সংঘর্ষ হয়।৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে কামালপুরের ছোট পাকিস্তানি ঘাঁটির পতন ঘটে, ২২০ জন পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে।
নামকরণ
হযরত শাহ জামাল (র.) এর নামানুসারে জামালপুর জেলার নামকরণ করা হয়েছে। তিনি ইসলাম ধর্মের একজন প্রচারক এবং একাত্মবাদের অনুসারী ছিলেন। তাঁর নামানুসারে এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয়।
- শাহ্ জামাল (র.): তিনি একজন ধর্মপ্রচারক এবং সাধক দরবেশ ছিলেন।
- নামের উৎপত্তি: তাঁর পূর্ণ স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এবং ইসলাম প্রচারের কারণে এই অঞ্চলের নাম “জামালপুর” রাখা হয়।
- পূর্বের নাম: জামালপুরের পূর্বের নাম ছিল সিংহজানি।
ভূগোল ও প্রশাসন
অবস্থান:
- উত্তরে: ভারতের মেঘালয়, কুড়িগ্রাম জেলা, শেরপুর জেলা।
- দক্ষিণে: টাঙ্গাইল জেলা।
- পূর্বে: শেরপুর জেলা, ময়মনসিংহ জেলা।
- পশ্চিমে: সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও গাইবান্ধা জেলা।
আয়তন
- আয়তন: ২০,৩১,১৮১ বর্গ কিমি।
- মোট জমির পরিমাণ: ৫,১২,৮১৯ একর।
উপজেলাসমূহ
- ইসলামপুর।
- জামালপুর সদর।
- দেওয়ানগঞ্জ।
- বকশীগঞ্জ।
- মাদারগঞ্জ।
- মেলান্দহ।
- সরিষাবাড়ী।
প্রশাসনিক তথ্য
- থানা: ৭টি।
- পৌরসভা: ৮টি।
- ইউনিয়ন: ৬৮টি।
- মৌজা: ৮৪৪টি।
- গ্রাম: ১৩৪৬টি।
- সংসদীয় আসন: ৫টি।
জনসংখ্যা
- মোট: ২৪,৯৯,৭৩৭।
- পুরুষ: ৫০.৫৮%।
- মহিলা: ৪৯.৪২%।
- ধর্মীয় বণ্টন: মুসলিম ৯৭.৭৪%, হিন্দু ১.৯২%, খ্রিষ্টান ০.০৭%, বৌদ্ধ ০.০৪%, অন্যান্য ০.১৪%।
- উপজাতি: গারো, হদি, কুর্মী, মাল।
অর্থনীতি ও শিল্প
- কৃষি: ধান, পাট, আখ, সরিষা বীজ, চিনাবাদাম, গম।
- শিল্প:
- নকশী কাঁথা ও চাদর (বকশীগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ, মাদারগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, সদর)।
- কাসা শিল্প (ইসলামপুর)।
- তাঁত শিল্প (দিকপাইত, মেষ্টা, তিতপল্লা)।
- মৃৎ শিল্প (গ্রামীণ মাটির বাসন ও তৈজসপত্র)।
- কুটির শিল্প (ডাংধরা ইউনিয়ন, দেওয়ানগঞ্জ)।
- কারখানা: যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (সার উৎপাদন)।
বিখ্যাত খাবার
- বিখ্যাত খাবার: মিল্লি (পিঠালি/মিলানি/ম্যান্দা) – গরু বা খাসির মাংস দিয়ে তৈরি ঐতিহ্যবাহী খাবার।
- ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প: নকশীকাঁথা, মৃৎ শিল্প, তাঁত শিল্প, কাসা শিল্প।
শিক্ষা
- গড় সাক্ষরতার হার: ৬১.৫৩%।
- প্রতিষ্ঠানসমূহ:
- সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: ১টি।
- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: ১টি।
- সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল: ১টি।
- টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও ইনস্টিটিউট: ১টি করে।
- সরকারি কলেজ: ৮টি, বেসরকারী কলেজ: ২০টি।
- মাধ্যমিক বিদ্যালয়: সরকারি ৭টি, বেসরকারী ২২৪টি।
- মাদ্রাসা: ১১০টি।
- প্রাথমিক বিদ্যালয়: সরকারি ৯০৮টি, বেসরকারী ৭০টি।
- কিন্ডারগার্টেন: ১৭৬টি।
- অন্যান্য: আইন কলেজ ১টি, হোমিওপ্যাথি কলেজ ১টি, কৃষি গবেষণা কেন্দ্র ১টি, কারিগরি ।প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ২টি।
দর্শনীয় স্থান
- হযরত শাহ জামাল (র.) মাজার, জামালপুর সদর।
- হযরত শাহ কামাল (র.) মাজার, দেওয়ানগঞ্জ ও মেলান্দহ।
- আল মসজিদ্দু আসছালাম জামে মসজিদ, শৈলেরকান্দা।
- দয়াময়ী মন্দির, সদর।
- গারো পাহাড় লাউচাপড়া, বকশীগঞ্জ।
- যমুনা নদী পাড়, দেওয়ানগঞ্জ।
- মেন্দা সুলতান স্টেডিয়াম, সদর।
- প্রজাপতি পার্ক ও উদ্ভিদ উদ্যান, সরিষাবাড়ী।
- জামালপুর জেলার বিভিন্ন ঘাট ও পার্ক: যমুনা জেটি, বাহাদুরাবাদ ঘাট, স্বপ্ননীল পার্ক।
হাসপাতাল সমূহ
- জামালপুর জেনারেল হাসপাতাল।
- জামালপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
- মাদারগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
- বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
- দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
- মেলান্দহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
- সরিষাবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
- ইসলামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
- সড়কপথ: মোট দৈর্ঘ্য ১০৪৩.৮ কিমি।
- রেলপথ: সদর উপজেলায় রেল যোগাযোগ।
- নৌপথ: বর্ষাকালে সীমিত আকারে।
উপসংহার
জামালপুর জেলা তার ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক সম্পদ, শিল্পকলা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এখানে কৃষি, নকশী কাঁথা, কাসা শিল্প, মৃৎ ও তাঁত শিল্পের সমৃদ্ধি চোখে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান জামালপুরকে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা হিসেবে পরিচিত করেছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
FAQ
১. জামালপুর জেলার আয়তন কত?
জামালপুর জেলার মোট আয়তন ২০,৩১,১৮১ বর্গ কিমি।
২. জামালপুর জেলার প্রধান খাবার কোনটি?
জামালপুর জেলার প্রধান এবং বিখ্যাত খাবার হলো মিল্লি (পিঠালি/মিলানি/ম্যান্দা)।
৩. জামালপুরে কতটি উপজেলা রয়েছে?
জামালপুর জেলায় মোট ৭টি উপজেলা রয়েছে: ইসলামপুর, জামালপুর সদর, দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, মাদারগঞ্জ, মেলান্দহ এবং সরিষাবাড়ী।
৪. জামালপুরে কোন শিল্পগুলো বিখ্যাত?
জামালপুরে নকশী কাঁথা, কাসা শিল্প, মৃৎ শিল্প, তাঁত শিল্প ও কুটির শিল্প বিশেষভাবে পরিচিত।
৫. জামালপুরে শিক্ষার অবস্থা কেমন?
জামালপুরে শিক্ষার গড় হার ৬১.৫৩%, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, কলেজ, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।



